গত ১০ বছরে দেশে স্বর্ণে বিনিয়োগ ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৫৫৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আর্ন্তজাতিক মূদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪০৩ মিলিয়ন ডলারে ১০ মেট্রিক টন স্বর্ণ কেনে।
বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার দাম কমা রোধে এই স্বর্ণ ক্রয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণের মজুদ বেড়ে ১৩ দশমিক ৫ টন হয়েছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণের মজুদ ছিল ৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।
স্বর্ণ ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বহুমুখী ব্যবহারের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে ১০ মেট্রিক টন স্বর্ণ কেনা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে স্বর্ণ কেনা উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।”
২০১০ সালে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বর্ণের শেয়ার বেড়ে ৫ শতাংশ হয়। তার আগে স্বর্ণের শেয়ার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ১৫ মার্চ ২ শতাংশ নিচে নেমেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর এখনো মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে স্বর্ণ মজুদে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ স্বর্ণের নৈতিক মূল্য আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দামের অস্থিরতা সত্ত্বেও ১৫ মার্চ পর্যন্ত এই ধরনের বিনিয়োগের অবাস্তব মুনাফা ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিংস স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থবছরের আর্থিক বিবরণীতে সম্পদের পাশাপাশি জাতীয় লাভের হিসাব করা হয়।”
অধিক মুনাফা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মহামারি করোনার বছরে হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগ করেনি। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনিশ্চয়তা কাটাতে বিনিয়োগের পোর্টফোলিও বাড়াতে স্বর্ণে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা বলেছেন, “ভবিষ্যতের ঝুঁকি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে স্বর্ণ কিনতে আগ্রহী নয়।”
স্বর্ণে বিনিয়োগের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল ও কোনো ব্যাংকের নিলাম থেকে স্বর্ণ কিনতে আগ্রহী নই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ভবিষ্যতে স্বর্ণের দাম আবার সাধারণ বা আগের অবস্থানে ফিরে এলে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।”
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যমতে, মূল্যবান ধাতু স্বর্ণের দাম চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ৩৪ শতাংশ বেড়ে প্রতি আউন্সের দাম হয়েছে ১৭৩০ ডলার। ২০১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রতি আউন্সের দাম ছিল ১২৫২ ডলার। মূলত কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অনিয়শ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ২০২০ সালের আগস্টের শুরুর দিকে প্রতি আউন্সের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২০৬৭ দশমিক ১৫ ডলার।
তবে সংক্রমণ কিছু কমা, অর্থনীতি সচল, টিকাদানের গতি বৃদ্ধি এবং মূলধনী বাজার বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে স্বর্ণের দাম কমেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। অপর দিকে বিশ্বব্যাপী টিকা দান কার্যক্রম শুরুর কারণে করোনা সংক্রমণ কমায় গত ৬ মাসে স্বর্ণের দাম ১১ শতাংশ বা ২১৩ ডলার কমেছে। সাধারণত মন্দার সময় অন্যান্য বিনিয়োগের চেয়ে কম অস্থির হওয়ায় স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) পরিচালিত সেন্ট্রাল গোল্ড রিজার্ভস (সিবিজিআর) ২০২০ সালের জরিপের তথ্যানুসারে, ২০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী ১২ মাসে স্বর্ণের মজুদ বাড়াতে চায়। ২০১৯ সালের জরিপে স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর পক্ষে মতামত দিয়েছিল ৮ শতাংশ ব্যাংক।
তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেকর্ড পরিমানে স্বর্ণ মজুদ করেছে। ২০১৯ সালে মজুদ করেছে ৬৫০ মেট্রিক টন স্বর্ণ। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল আউটলুক-২০২১ বলছে, গত বছরের শেষের দিকে বিনিয়োগকারীরা মনে করেছিল মহামারি শেষ হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল পূর্বাভাস দিয়েছিল, স্বর্ণ বিনিয়োগের চাহিদা ভালোভাবে সমর্থন করবে। স্বর্ণের ব্যবহার বিশেষ করে উদীয়মান বাজারগুলোতে নতুন করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১৪ টন স্বর্ণ মজুদ আছে, যা মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ২ শতাংশ। ১৫ মার্চ পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ স্বর্ণ মজুদে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
স্বর্ণ মজুদের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির স্বর্ণ মজুদের পরিমান ৬৭৭ মেট্রিক টন, যা মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৭ শতাংশ। ৬৫ মেট্রিক টন স্বর্ণ মজুদ করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, যা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ২১ শতাংশ। বাংলাদেশের মজুদ ১৪ মেট্রিক স্বর্ণের মধ্যে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর আটক করা ৪ মেট্রিক টন স্বর্ণ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ৪ মেট্রিক টন স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মজুদে অর্ন্তভূক্ত করা হবে। এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। জব্দকৃত স্বর্ণ শুধু ভল্টে জমা আছে। আইনগত জটিলতা নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনির কাছ থেকে এসব স্বর্ণ কিনে নেবে। বস্তুগত স্বর্ণ এবং রৌপ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে সংরক্ষণ করা হয়।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে মার্কিন ডলারে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং দীর্ঘ মেয়াদী বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। অপর দিকে কিছু পরিমান অর্থ ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুর ডলার, চায়না রেনমিনবি এবং জাপানি ইয়ানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। বস্তুগত ব্যবহারে স্বর্ণ একটি মূল্যবান ধাতু। তবে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা বিনিয়োগ হিসেবে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ধারা।