করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় টেউ মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ‘সর্বদলীয় কমিটি’গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার (৯ এপ্রিল) বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, আমরা আবারো প্রস্তাব রাখছি যে, এখনো সময়ে আছে, সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে, জনগণকে সম্পৃক্ত করে-তাহলেই শুধুমাত্র এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। একটা কথা আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, বিশাল চ্যালেঞ্জ তা জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সম্ভব নয়।
জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে আমরা যেটা এর আগেও বলেছি, রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি সকল স্তরের মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষকে এই ব্যাধির যে ভয়াবহতা সেই সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দিতে হবে এবং তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে এই মোকাবিলা করার যুদ্ধের সঙ্গে। আসুন আমরা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ নেই মানুষ বাঁচাই, দেশ বাঁচাই।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখন যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যে, মানুষের জীবন ও জীবিকাকে রক্ষা করা। আমরা সরকারকে আহ্বান করব যে আজকে প্রতিটি ইনফরম্যাল সেক্টারের যারা উদ্যোক্তা আছেন তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রণোদনা দিতে হবে। এই ইনফারম্যাল সেক্টারে যারা কাজ করছেন, শ্রমিক রয়েছেন বিভিন্ন দোকান-শিল্প কলকারখানায় তাদেরকেও ভাতা প্রদান করতে হবে এবং সেটা যত দিন এই সমস্যা থাকবে বিশেষ করে লকডাউন থাকবে তাদেরকে ভাতা প্রদান করতে হবে। বিশেষ করে যারা একেবারে দিন আনে দিন খায় মানুষ তাদেরকে ব্যাপক হারে ত্রাণ সামগ্রী দিতে হবে তাদের বেঁছে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য।
সকল মানুষের জন্য করোনার টিকা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যেটা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশকে যদি আপনার হার্ড ইম্যুনিটির মধ্যে আনতে হয়, তাহলে কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে যে, সাড়ে ১২ হাজার কোটি টিকার এখন পর্যন্ত কোনো সংস্থান হয় নাই। আমরা আজকে দেখলাম, চীন ও রাশিয়া থেকে তারা টিকা আনার কথা ভাবছে। এখন আমাদের এই মুহুর্তে দরকার। এক বছর আগে থেকে এটা করলেন না। একবছর ব্যস্ত থাকলেন তাদের বিভিন্ন বর্ষ উদযাপনের জন্য, বিভিন্ন রকম তাদের যেসমস্ত দৈনন্দিন কাজগুলো রয়েছে বিশেষ করে মেগা প্রজেক্ট, ডেভেলমেন্ট প্রজেক্ট সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন।
আজকে আমরা প্রস্তাব রাখতে চাই, মানুষের মধ্যে হার্ড ইম্যুনিটি তৈরি করার জন্য সাড়ে ১২ কোটি টিকা সংগ্রহ করতে হবে। এই টিকা সংগ্রহ করা জন্য সরকারের উচিত হবে এখনই এই মুহুর্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, রোডম্যাপ তৈরি করা কিভাবে আসবে, কিভাবে বিতরণ হবে, কিভাবে যাবে জনগণের কাছে।
করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন হাসপাতালে বেড ও আইসিইউ সংকট, করোনা পরীক্ষার অপ্রতুলতাসহ যে দূরাবস্থা চলছে তার জন্য সরকারের ‘ব্যর্থতা, উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা’কে দায়ী করেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, আমরা দেখতে পারছি যে, গত বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা টেস্ট করা হয়েছিলো ১০ লক্ষ ৭ হাজার ৭০৩ জনের। এবার আমরা দেখতে পারছি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টেস্ট করা হয়েছে ২ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো। অর্থাৎ এবার কিন্তু টেস্ট বেশি করা উচিত ছিলো, সেটাও করতে পারেনি। মহামারি মোকাবিলায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর ধারে কাছে আমরা যেতে পারিনি। তাই জনগণের প্রশ্ন জেগেছে- টেস্ট বাড়ানো কমানো সরকারের অপকৌশল কি না। অবশ্যই একটা অপকৌশল।
‘সর্বাত্মক লকডাউন অর্থ কী’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা যেটা দেখছি, সরকার যে লকডাউন ঘোষণা করেছে, সেটা ক্যারিআউট হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী বলেছেন, ১৪ তারিখ থেকে নাকি সর্বাত্মক লকডাউন করা হবে। আমরা জানি না সর্বাত্মক লকড়াউনের অর্থটা কী? জনগণ জানে না এবং তার বিকল্প কি ব্যবস্থা করা হয়েছে সেই সম্পর্কেও জনগণ জানে না। সর্বাত্মক লকডাউন করা বিশেষ করে রোজার সময়ে সেটা কীভাবে সমন্বয় করা হবে সে সম্পর্কে কোনো রোডম্যাপ দেয়া হয় নাই।
তিনি বলেন, সর্বাত্মক বা শক্ত লকডাউনে যখন যাবে বিশেষ করে শ্রমিকরা সাধারণ মানুষরা যারা দিন আনে দিন খায়, যারা দিনমজুরের কাজ করে, রিকশা চালায়, বাসায় কাজ করে, ইনফরম্যাল সেক্টারগুলোতে কাজ করে, যারা ছোট ছোট ফ্যাক্টরীতে কাজ করে, তাদের ব্যবস্থা কি হবে তা এখন পর্যন্ত আমরা জানি না। গত বারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সরকার একটা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই প্রণোদনা কিন্তু সাধারণ মানুষের খুব বেশি উপকার হয়নি বরঞ্চ দুর্নীতি বেশি হয়েছে।
গত বছর করোনার সময়কালে সাধারণ মানুষের পাশে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বিএনপির থাকার কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, দুঃসময়ে বিএনপি সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকে। আমরা গতবছরও জনগণের কাছে সমস্ত ইউনিট যথাসাধ্য সম্পদ নিয়ে সাধারণ মানুষজন ও করোনা আক্রান্তদের যে সেবা দেয়া দরকার সেটা দিয়েছি। এবারও আমরা সকল ইউনিটকে অনুরোধ করেছি যে, তারা যেন আক্রান্ত ও সাধারণ মানুষজন যারা বিপদগ্রস্থ হচ্ছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সস্ত্রীক খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান এজেডএম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলের ব্যাপক নেতা-কর্মীরা করোনায় আক্রান্তের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সারা দেশে চার শতাধিক নেতা-কর্মী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত কয়েকদিন আগের হিসাবৎঅনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজারের অধিক। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বারডেম হামপাতালে চিকিৎসাধীন বুদ্ধিজীবী লেখক বদুরুদ্দীন উমর ও তার স্ত্রী সুরাইয়া হানমের আশু রোগমুক্তি কামনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকায় সফরের সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাক্ষণবাড়ীয়ায় সংঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার অসংখ্য মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব। অতিসম্প্রতি ফরিদপুরে সালতা সাধারণ মানুষের সাথে সংঘর্ষের পর সাধারণ মানুষজনসহ বিএনপির বেশিরভাগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ঘটনা সরকারের ‘হীন চক্রান্ত ও বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র’বলে এহেন সরকারি তৎপরতার নিন্দা জানান তিনি।
বিভিন্ন থানায় ভারী অস্ত্রের পাহারা প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, হাস্যকর নাটক সাজিয়ে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে বসানো হয়েছে মেসিনগান পোস্ট। সেই দৃশ্য আমরা দেখেছি ১৯৭৪ সালে, ২০১৩-১৪-১৫ সালে। আমরা স্পষ্টভাষায় জানাতে চাই, বিএনপি সহিংসতায় বিশ্বাস করে না এবং জনগণের বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।
আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময় সংগ্রাম করেছে, আন্দোলন করেছে। বিএনপির ২০০৯ সাল থেকে এই অবৈধ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আজ বন্দি অবস্থায় আছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব নির্বাসিত হয়ে আছেন, ৩৫ লক্ষ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে। সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি-সংগঠনের প্রতি আহ্বান ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবো, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব, সেই লক্ষ্যে আসুন আমরা কাজ করি।