করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশজুড়ে সরকার ঘোষিত ৮ দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে আজ থেকে। বুধবার (১৪ এপ্রিল) ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মাঠে রয়েছেন সিভিল প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কঠোর লকডাউন কার্যকরে বিভিন্ন জায়গায় তৎপর রয়েছে পুলিশ। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে। এসব চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের পরিচয় এবং রাস্তার বের হবার কারণ জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
যেসব পেশার মানুষ জরুরি সেবার সাথে সম্পৃক্ত তাদের চেকপোস্ট অতিক্রম করার অনুমতি দিয়ে অন্যদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বহু রাস্তা বেরিকেড বসিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেসব রাস্তায় জরুরি সেবা সংস্থার কোন যানবাহনও যেতে পারছে না, যেতে হচ্ছে বিকল্প রাস্তায়।
পুলিশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে , বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকর করতে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাস্তবায়নে এবার কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। এজন্য মুভমেন্ট পাস ছাড়া কাউকে বাড়ির বাইরে আসতে দেয়া হবে না বলে পুলিশ জানিয়েছে।
লকডাউনের ৮ দিন সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে গণপরিবহন। তবে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান-সংস্থা খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে শিল্প-কারখানা। সীমিত পরিসরে দেয়া হচ্ছে ব্যাংকিং সেবা। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। খোলা স্থানে কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কেনা-বেচা করা যাবে।
লকডাউনের এই সময়ে মানতে হবে যেসব নির্দেশনা…
১. সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে ও সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। তবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
২. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। (আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং দেশের অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়ালি সীমিত পরিসরে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট)।
৩. সকল প্রকার পরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে, পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না।
৪. শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেয়া নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
৬. অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ঔষধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।
৭. খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোরর ৬টা পর্যন্ত কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ (সরাসরি/অনলাইন) করা যাবে। শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে।
৮. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
৯. বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষি শ্রমিক পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে।
১০. সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে।
১১. স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেবেন।
১২. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জুমা ও তারাবি নামাজের জমায়েত বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করবে।
১৩. এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ প্রয়োজনে সম্পূরক নির্দেশনা জারি করতে পারে।
এ দিকে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি ঘোষিত লকডাউনে জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া ও ফিরে আসার জন্য পুলিশের বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে আলাদা মুভমেন্ট পাস নিতে হবে। বুধবার থেকে শুরু হওয়া আট দিনের লকডাউন চলাকালে জনসাধারণের এই পাস নিতে হলেও গণমাধ্যমকর্মীদের এই পাস লাগবে না। তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্রই মুভমেন্ট পাস হিসেবে গণ্য করা হবে বলে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের মহাপরদির্শক (আইজিপি) লকডাউনে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ এই অ্যাপের উদ্বোধন করেন। মুভমেন্ট পাস নামের অ্যাপটি উদ্বোধনের পর প্রতি মিনিটে ১৫ হাজার আবেদন জমা পড়লেও সন্ধ্যার দিকে তা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার। প্রথম ঘণ্টায় আবেদন জমা পড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার। মঙ্গলবার অ্যাপটির উদ্বোধন করেন।
দুপুরের দিকে অতিরিক্ত চাপ থাকায় মুভমেন্ট পাসের (https://movementpass.police.gov.bd) এই ওয়েব ঠিকানায় ঢোকা যাচ্ছিল না বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পরে সার্ভারের সংখ্যা আরও বাড়ালে সন্ধ্যার দিকে তা স্বাভাবিক হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সারা দেশ থেকে পুলিশের মুভমেন্ট পাসের জন্য ৬ লাখ আবেদন করা হয়। এর মধ্যে ৬০ হাজার আবেদনে পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ৩০ হাজার আবেদনকারী মুভমেন্ট পাস পেয়েছেন।
লকডাউনে বাসা থেকে নিতান্ত প্রয়োজনে কাউকে বের হতে হলে মুভমেন্ট পাসের জন্য ওপরের ওয়েব ঠিকানায় ঢুকে আবেদন করতে হবে। শুরুতে একটি সক্রিয় মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হবে। আবেদনকারী কোথা থেকে কোথায় যাবেন, তা জানতে চাওয়া হবে। সেই সব তথ্য ধাপে ধাপে দিতে হবে।
এরপর আবেদনকারীর একটি ছবি আপলোড করে আবেদন জমা (সাবমিট) দিতে হবে। এরপর ফিরতি মেইল বা বার্তা আবেদনকারীকে পাঠানো হবে। সেটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট নেওয়া যাবে। প্রিন্ট কপিটিই মুভমেন্ট পাস হিসেবে গণ্য করা হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় এর আগে গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লকডাউন বা বিধিনিষেধ ছিল। তবে গণপরিবহন, মার্কেট খোলা রেখে এই লকডাউন ছিল অনেকটাই অকার্যকর।