বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তির যুগেও দাসপ্রথার মতো বাজারে বিক্রি হচ্ছে শত শত শ্রমজীবী মানুষ! ক্রেতাদের কাছে তারা কেউ কেউ এক সপ্তাহ আবার কেউ কেউ একমাস চুক্তিতে ধানক্ষেতে রোপণ, পরিচর্যা ও ধান কাটা, সবজি চাষাবাদের জন্য বিক্রি হন। করোনা মহামারীতেও জীবন বাঁচাতে জীবিকার খোঁজে বিক্রি হতে আসে শত শত মানুষ। তারা নিজের ইচ্ছেতেই বিক্রি হয়!
সোমবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ৭টা থেকে ৮টার দিকে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা সদরে হাতে-পিঠে ব্যাগ, পুঁটলা বাঁধা এসব মানুষের ভিড় দেখা যায়। এরা খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে আসা অভাবী মানুষ।
বছরের বৈশাখ মাসের শুরু থেকে শেষ সময় পর্যন্ত বোরো ধান কাটার এ সময় শ্রমজীবী মানুষের চাহিদা ডুমুরিয়া এলাকায় অনেক বেশি। তবে করোনা মহামারির এই সময়ে প্রতি শুক্র ও সোমবারে ডুমুরিয়া বাজারের কালিবাড়ী মোড়ে শ্রম বিক্রির হাটে (স্থানীয় ভাষায়, কিষেন হাট) মানুষের ভিড় হচ্ছে অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
এই শ্রম বাজারটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ রোধে হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি হাটটি ডুমুরিয়া কলেজ মাঠে স্থানান্তরিত করেছে।
শত শত শ্রমজীবী মানুষ হাটে আসেন বিক্রি হতে এবং উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গৃহস্থ মানুষ কৃষিকাজের জন্য তাদের কিনে নেন। চলতে থাকে অন্যান্য পণ্যের মতো দর-কষাকষি। সকালবেলা চাহিদা বেশি থাকে। শ্রমজীবীরা দামও বেশি পান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে চাহিদা কমে যায় এবং দামও কমে আসে।
স্থানীয়ভাবে শ্রমজীবীদের বলে ‘দিনমজুর’, আবার কেউ বলে ‘কামলা’ বা ‘কিষেন’। ১৮ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ৭৫ বছরের বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে দলে দলে ছুটে আসেন এ হাটে।
এ মানুষগুলোর বেশিরভাগই হতদরিদ্র শ্রমজীবী। ক্রেতাদের কাছে তারা কেউ কেউ এক সপ্তাহ আবার কেউ কেউ একমাস চুক্তিতে ধান ক্ষেতে রোপণ, পরিচর্যা ও ধান কাটা, সবজি চাষাবাদের জন্য বিক্রি হন। আমন-বোরো ক্ষেত চাষাবাদের সময় এ অঞ্চলে দিনমজুর বা কৃষিকাজের মানুষের বরাবরই অভাব থাকে।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) সরেজমিনে ডুমুরিয়া কলেজ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত চার হাজার শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি। শ্রমিক ক্রেতার গৃহস্তের সংখ্যাও অনেক। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা চুক্তিতে শ্রম বিক্রি হচ্ছে। তবে শ্রম কেনা মালিকের পছন্দের ওপর নির্ভর করে শ্রমের মূল্য। বৃদ্ধের চেয়ে জোয়ানদের চাহিদা বেশি। তবে অনেকে শরীরের গঠন দেখেও ক্রয় করেন। এ যেন পণ্য বিক্রির হাট!
শ্রমজীবীরা জানান, বিক্রি হতে আসা মানুষ যেদিন নিজেকে বিক্রি করতে না পারেন, সেদিন রাত কাটান বাজারের কাছাকাছি মসজিদ, মাদরাসা অথবা স্কুলের বারান্দায়। কখনো থাকেন আধা পেটে, কখনো উপোস। সকাল থেকেই ফের বিক্রি হওয়ার আশায় শুরু হয় তাদের ছোটাছুটি।
বাজারে বিক্রি হতে আসা সাতক্ষীরার শ্যামনগর এলাকার বয়োবৃদ্ধ আমজু মিয়া জানান, কৃষিকাজেই ব্যয় হয়েছে তার যৌবনকাল। এ সময়টায় অবসরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে এখন ডুমুরিয়া হাটে। এখানে শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হয়েছেন তার মতো আরও শত শত অভাবী মানুষের।
খুলনার কয়রা উপজেলার কৈখালী গ্রামের বাসিন্দা অমেদ আলী ফকির (৭০) জানান, চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলে স্থানীয় একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করে। অভাবের সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জমিজমাও তেমন নেই। বর্গাচাষ করেই চলে সংসার। কিন্তু করোনা মহামারিতে অভাবে পড়ে বর্গাচাষও করতে পারেননি। ঘরে খাবার নেই। এলাকায় কাজও নেই। তাই কাজের সন্ধানে তিনি হাটে এসেছেন।
তিনি আরো জানান, তার ঘরে পাঁচজন মানুষ, শরীরও খারাপ। তারপরও অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে এসেছেন। এখানে মানুষ বেশি, কাজ পাওয়া যায় বেশি। তার দুঃখ বৃদ্ধ হওয়ায় অনেকেই তাকে কাজে নিতে চান না।