ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নতুন রোগীর চাপ সামলাতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের। ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা হারানোর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন ও চিকিৎসা কার্যক্রম জোরদার করেছিলো সু চির সরকার।
অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেওয়ার পর মিয়ানমারে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্যান্য কার্যক্রমের পাশপাশি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত হয়। চিকিৎসক এবং নার্সরা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা কার্যক্রম প্রায় ভেঙে পড়ে।
শ্বাস নিতে পারছে না, শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সবরাহ নেই- ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের একটি হাসপাতালের এমন ছবি বলছে, ভেঙে পড়ার মুখে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সীমান্তবর্তী চিকায় একটি হাসপাতালে সাত জন কোভিড-১৯ রোগীর সেবায় নিয়োজিত প্রধান নার্স লুন জা এনকে সহায়তার জন্য তার পাশে আছেন শুধু একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান এবং একজন ফার্মেসি অ্যাসিসটেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা রোগীদের সান্ত্বনার বাণী আর প্যারাসিটামল দিচ্ছেন।
দশ হাজার বাসিন্দার ওই শহরের লুন জা এন (৪৫) রয়টার্সকে বলেন, “আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিদ্যুৎ, চিকিৎসক বা অ্যাম্বুলেন্স নেই। হাসপাতলে ১১ জনের জায়গায় মাত্র তিন জন কর্মী কাজ করছি।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে, জান্তাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্তত ১৩ চিকিৎসাকর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বা দমন অভিযানে নিহত হয়েছেন। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ও স্বাস্থসেবা পরিবহন ব্যবহার ওপর এ পর্যন্ত ১৭৯ বার হামলা চালিয়েছে জান্তা বাহিনী।
ডব্লিউএইচওর মিয়ারমারের প্রতিনিধি স্টেফান পল জোস্ত জানিয়েছেন, এ বছর বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর যতগুলো হামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে।
সামরিক জান্তা এখন পর্যন্ত দেড়শ স্বাস্থ্যকর্মীকে আটক করেছে। সরকারি নির্দেশ অমান্যের অভিযোগে আরও শতাধিক চিকিৎসক ও নার্সের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রয়টার্স লিখেছে, এ বিষয়ে তাদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি সামরিক কর্তৃপক্ষের কোনো মুখপাত্র বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ।
ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে মহামারী মোকাবেলাকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে বারবার চিকিৎসাকর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে সামরিক বাহিনী। তবে তাতে খুব কমই সারা মিলছে।
মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগনের একটি কোভিড-১৯ কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রের একজন কর্মী জানান, স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রায় সব বিশেষজ্ঞই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ কেন্দ্রে আমরা পরীক্ষার জন্য নতুন রোগী পাচ্ছি না, কারণ পরীক্ষা করার কর্মী নেই।”
অথচ অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগেও চিত্রটি ছিল পুরো বিপরীত। দেশজুড়ে গড়ে দিনে ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছিল। আর বুধবার পর্যন্ত গত সাত দিনে গড় দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা নেমে এসেছে এক হাজার ২০০ জনে।
শনিবার পর্যন্ত মিয়ানমারে কোভিড-১৯ এ মারা গেছেন তিন হাজার ২০০ জন; আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৪০ হাজারের বেশি। অবশ্য পরীক্ষার সংখ্যা দারুণভাবে কমে যাওয়ায় মৃত্যু ও সংক্রমণের এই হিসাব নিয়ে সংশয় রয়েছে।
মিয়ানমারের স্বাস্থ্যসেবা খাতের বর্তমান ভঙ্গুর দশা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। প্রতিবেশী ভারত, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন মিয়ানমারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নার্স লুন জা এন জানান, চিকায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা এতটাই খারাপ যে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি। রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন তারা। নেবুলাইজার ব্যবহার করে শ্বাসকষ্ট কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শহরে সারাদিনে যে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে, সে সময় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর চালিয়ে রাখা হয়।
অসুস্থদের ছেড়ে যেতে পারছেন না বলেই জান্তার বিরুদ্ধে ধর্মঘটে যোগ দিতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “জান্তা আমাদের রোগীদের সেবা করবে না।”
মিয়ানমারজুড়ে আন্দোলনে যোগ দেওয়া চিকিৎসকদের অনেকে রোগীদের সাহায্য করতে গোপনে ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। ইয়াংগনের শহরতলীতে তিনটি ক্লিনিকে মিয়ানমার রেড ক্রস স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম চালুর পর দ্রুতই সেখানে ডজনখানেকের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে।
মেডিসিনস স্যানস ফ্রনটিয়ারর্স (এমএসএফ) এর মিয়ানমার শাখার প্রধান মারজান বেসুইজেন বলেন, “এদেশে হাসপাতালগুলোর ৮০ শতাংশই সরকারি। এমএসএফ বা অন্যদের জন্য এককভাবে এত বড় কাঠামোকে সহায়তা করা কঠিন।”