গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি আর উজানের ঢলে এক সময়ের প্রমত্তা নদী তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরেকদিকে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যেই একটি বাঁধসহ নদী গর্ভে চলে গেছে অনেকের ভিটামাটি ও আবাদি জমি। তলিয়ে গেছে বাদাম, ভুট্রা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত।
এ কারণেই ভাঙন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তার তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের। নদী ভাঙনের মুখে পড়ে শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে গ্রামবাসীর দাবি তারা ত্রাণ চায়না, তাদের দাবি নদী ভাঙন থেকে রক্ষা করা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তার অব্যাহত ভাঙন ও তলিয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চর বিনবিনা, বাঘেরহাট, চর বাগডোকরা, শংকরদহ, পূর্ব ইচলি, ছালাপাক, চল্লিশসালসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের ঘরবাড়ি। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে মহিপুর এসকেবাজার-সংলগ্ন রংপুর-কাকিনা রোডের ব্রিজ ও চরের রাস্তাঘাট।
একই চিত্র কাউনিয়া উপজেলায় গত দুইসপ্তাহে তিস্তার কড়াল গ্রাসে ঢুষমারা,তালুক শাহাবাজ, কালীরহাট গ্রামের অন্তত অর্ধশতাধিক পরিবারের বসতভিটা ও কয়েকশত বিঘা ফসলি জমি, বাশঝাঁড়, গাছপালা ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
একই উপজেলার তালুক শাহবাজ, নিজপাড়া, পাঞ্চরভাঙ্গা, ঢুষমারা, আরাজী হরিশ্বর, চর হয়বৎখাঁ, চরগনাই গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার রয়েছে হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙনের ভয় আর উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে পাঁচ গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের মানুষেরা। এছাড়াও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, কাশিম বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এখানকার হাট-বাজার, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও আবাদি জমি হুমকির মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙনের ভয় আর উৎকণ্ঠায় রয়েছে তিস্তা নদী বেষ্টিত লালমনিরহাট, আদিতমারী, হাতিবান্ধা, নীলফামারীর ডিমলা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর ও রংপুরের পীরগাছার ছাওলা-তাম্বুলপুরের তিস্তার চরবর্তী গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।
এ ব্যাপারে গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব আলী রাজু বলেন, চরবাসীকে তিস্তার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষার্থে বর্ষা মৌসুমের আগেই প্রায় ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে স্বেচ্ছাশ্রম বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অসময়ে তিস্তায় পানি বৃদ্ধি ও বিনাবিনার চরে পানির তীব্র স্রোতে বাঁধটির বেশির ভাগ অংশ ভেঙে গেছে।
কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী ভাঙন কবলিত নিজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুনিল চন্দ্র ও কৈশব চন্দ্র জানান, আর কতো বার বাড়ি-ঘর সরামো, নদী তো আর সময় দেয় না। জমি, ঘরবাড়ি, বাপ-দাদার ভিটা সউগ ভাংগি যাবার নাইগছে। নদী ভাংগনে হামার এই গ্রামটাকে শ্যাষ করি ফ্যালাইল বার নাগছে। এ্যালা হামরা বউ-ছাওয়াক নিয়া কোন যাম।
কাউনিয়ার টেপামধুপুর ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, গত দুইসপ্তাহে তিস্তার তীব্র ভাঙনে ইতিমধ্যে তাঁর ইউনিয়নের অনেকের বসতভিটা, গাছপালা ও আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী গ্রামের কয়েক শতাধিক ঘরবাড়ী ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে।
তিনি বলেন, জরুরি ভিত্তিতে নদী শাসন ও বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। তা না হলে, মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে অনেকের ভিটামাটি ও আবাদী জমি।
পূর্ব তালুক শাহাবাজের ক্ষিরোদ চন্দ্রসহ আরও কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, কি করমো বাহে হামার এলাকার সবার বাড়িঘর আবাদি জমি সইগ তিস্তা নদী গিলি খাইল। তাও কায়েও দেখে না কি করি মানুষগুলা বাঁচি আছে। জীবন আর চলে না। কাম নাই প্যাটত ভাত নাই। শেষ পর্যন্ত মাথাগুজি থাকার সম্বলটাও নদীত চলি যাওছে।
তিস্তার পাড়ে বসবাসকারী রঞ্জিত চন্দ্র বলেন, ‘তিস্তা ভাঙে আর নদীর উপরা কোনো মতে মাথা গুজি থাকি। এমন করি তিন তিনবার সউগ ভাংগি নিয়্যা গেইচে, এবারও নদীর পাড় ভাইংবার নাইগছে। এলা যামো কটাই, মাথা গুজমো কটাই।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, তিস্তার তীর ভাঙ্গন রোধে গাইড বাঁধ নির্মাণের জন্য বিগত সময়ে একটি প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে প্রকল্পটি স্থাগিত রয়েছে। এছাড়াও গঙ্গাচড়ার বিনবিনার চরের বাঁধটি রক্ষায় পরিকল্পিত ভাবে কাজ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, নদী ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।