ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পরিকল্পিতভাবে বাবা-মা ও ছোট বোনকে হত্যা করে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল করে নিজেই পুলিশকে জানান মেহজাবিন মুন।
ঢাকার কদমতলীতে চাঞ্চল্যকর তিন খুনের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর গতকাল রোববার মুনের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মুনকে আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপ-পরিদর্শক জাকির হোসাইন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত শনিবার দিনগত রাতে তিন খুনের ঘটনায় মুন ও তার স্বামী শফিকুল ইসলামকে আসামি করে মামলা করেন মুনের চাচা ও নিহত মাসুদ রানার বড়ভাই শাখাওয়াত হোসেন। এরপরই মুনকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। মুনের স্বামী শফিকুল পুলিশি হেফাজতে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নেপথ্যে পারিবারিক কলহ, দেহ ব্যবসা ও স্বামীর পরকীয়া
হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে মুন ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এ ঘটনার নেপথ্যে পারিবারিক কলহ, স্বামীর পরকীয়া, দেহ ব্যবসাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং পরিবারের সব সদস্যের অসুস্থ, অনৈতিক ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণেই এ হত্যাকাণ্ড।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিহত মৌসুমী ইসলাম উচ্চবিত্তদের নারী সরবরাহ করতেন। মেয়ে মেহজাবিন মুন ছিলেন এক নেতার বেডপার্টনার। মা-মেয়ের মধ্যে দেহব্যবসা নিয়ে ঝামেলা হয়। এর রেশ ধরে মুন পরিকল্পিতভাবে সবাইকে হত্যা করেন বলে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, মুনের মা মৌসুমী সাবেক একজন বিএনপি নেতার পিএস হত্যা মামলার আসামি। মুনের বাবা মাসুদ রানা দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। স্ত্রী-মেয়ের এসব অপকর্মের বিষয়ে তিনি জানতেন। এ ছাড়া মুনের সঙ্গে তার স্বামী শফিকেরও দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল। মুনের ছোট বোন নিহত জান্নাতুল ইসলামের সঙ্গে শফিকের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল এ কলহের অন্যতম কারণ।
এসব বিষয়ে ডিএমপির ওয়ারি বিভাগের উপ-কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মুন জানিয়েছে, তার বাবা মাসুদ রানা প্রবাসে থাকতেন। তিন মাস আগে তিনি ওমান থেকে দেশে ফেরেন। যখন তার বাবা বিদেশে ছিলেন তখন মুনের মা তার দুই মেয়েকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করাত। এসব নিয়ে তারা প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
তিনি অরও বলেন, মুনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও তার ছোট বোনকে দিয়ে দেহ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল মা। এর মধ্যেই মুনের স্বামীও তার ছোট বোনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ ছাড়া মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা ওমানে আরেকটি বিয়ে করেছেন। এসব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকেই পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মুন।
মুনের চাচাতো বোন শিলা বলেন, গত দুদিন আগে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে মুন। এসেই তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়া রয়েছে বলে বাবা-মার কাছে অভিযোগ করে। এ নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। তার জেরেই হয়তো এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
মুন ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে আগেও হত্যা মামলা হয়েছে
পুলিশ জানিয়েছে, মুনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মুনের সঙ্গে তার মা নিহত মৌসুমী ইকবাল এবং তার আরেক খালাও ওই হত্যা মামলার আসামি। মামলাটিতে তারা জামিনে ছিলেন।
গতকাল রোববার কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর জানান, ২০১৬ সালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় মুন, তার মা ও আরেক খালার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়। ওই মামলায় তারা জামিনে ছিলেন। যে ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ব্যক্তির সঙ্গে মুনের মায়ের পরিচয় ছিল। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই সময়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এদিকে মুনের স্বামী শফিকের বিরুদ্ধেও আগে হত্যা মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে মুনের পরিবার। মুনের খালা ও নিহত মৌসুমীর বোন ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার ভাগ্নি মুনের স্বামী শফিক একজন খুনি ও একাধিক মামলার আসামি। ৫ বছর আগে সে একজনকে হত্যা করে। সেই হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে টাকার জন্য ভাগ্নি মুনের সঙ্গে তার স্বামী শফিকুলের প্রায়ই ঝগড়া হতো। তাছাড়া শফিক তার শালি আমার আরেক ভাগ্নি জান্নাতুল ইসলামের সঙ্গে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করত। এ ঘটনা আমার নিহত বোন মৌসুমী জানতে পেরে জামাতা শফিককে বাধা দেন। এ নিয়ে মুন এবং আমার বোনের সঙ্গে শফিকের প্রায়ই ঝগড়া হতো।’