বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরানো হলেও চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। যা দেশের কোনো হাসপাতালে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে তার পরিবার এবং দল বিদেশে চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের ‘শর্তের বেড়াজালে’ আটকে আছে খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা। এতে বিএনপিপ্রধানের শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার পরিবার এবং দলের মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বাড়ছে। নেতাকর্মীরাও তাদের প্রিয় নেত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কায় দিন পার করছেন।
এদিকে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দলের চেয়ারপারসনের আশু রোগমুক্তির জন্য দোয়া করেন তারা। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে টানা ৫৩ দিন চিকিৎসা শেষে গত শনিবার বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। বাসায় ফিরলেও হার্ট, কিডনি ও লিভার সমস্যায় ভুগছেন তিনি। পুরনো অসুখ আর্থারাইটিসও রয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
হাসপাতালে সংক্রমণের শঙ্কায় খালেদা জিয়াকে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজাতে’ই চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কোভিড-পরবর্তী তিনবার রক্তে ইনফেকশন হয়েছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে হাসপাতালে রাখা নিরাপদ মনে করছেন না তারা। ফলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য লিখিত প্রতিবেদনে সুপারিশও করেছেন তারা।
জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাতে চান। দলের সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ এতে মত দিয়েছেন। কিন্তু ‘প্রভাবশালী’ একটি অংশের মতবিরোধ রয়েছে। ফলে দলে সিনিয়র অনেক নেতাই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও রয়েছেন অন্ধকারে। তাদের দাবি, নেত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তাদের কাছে কোনো সঠিক তথ্য নেই।
জানতে চাইলে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা পুরোপুরি অবগত নই। আসলে উনি ভালো নেই। আমাদের কাছেও সঠিক তথ্য নেই। আমরা উদ্বিগ্ন। উনার উন্নত চিকিৎসা দরকার এটাই চাই।’
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শরিফ উদ্দিন জুয়েল বলেন, ‘দেশনেত্রী আমাদের আবেগের জায়গা। উনি সুস্থ থাকলেই আমরা প্রাণ ফিরে পাই। উনার অসুস্থতায় আমরা উদ্বিগ্ন। শঙ্কা নিয়ে দিনানিপাত করছি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। চিকিৎসকের মাধ্যমে যতটুকু জেনেছি উনার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। যা বাংলাদেশে নেই।’
ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ সালমান ওমর রুবেল বলেন, ‘কেউ বলেন দেশনেত্রী সুস্থ আছেন, আবার কেউ বলেন তিনি অনেক অসুস্থ। কোনটা বিশ্বাস করব? এসব আমাদের আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’
হাসপাতালে ভর্তির আগে-পরে বিদেশ চিকিৎসার দেওয়ার বিষয়ে পরিবার এবং এবং দল থেকে দাবি জানানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকারের কাছে আবেদন করেন পরিবারের সদস্যরা। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে ৯ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে সরকার অনুমতি দেবে না। কিন্তু এরপরও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, খালেদা জিয়া আর ‘রাজনীতিতে ফিরবেন না’- এই শর্ত মেনে হলেও তাকে বিদেশে চিকিৎসা দিতে চান পরিবারের সদস্যরা। খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে দলের বড় একটি অংশের নেতাকর্মীদের বিষয়টিতে সায় রয়েছে।
খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দীর্ঘ চার বছর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা না হওয়ায় এবং কারাগারে রাখার কারণে তিনি অনেকগুলো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে প্রথম তার হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা তৈরি হয়েছে, লিভারে সমস্যা হয়েছে। তার পুরনো অসুখ আর্থারাইটিসও রয়েছে। সবগুলো মিলে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। এসব রোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন।
গত ২৭ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। তার চিকিৎসার জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ছয়দিন পর ৩ মে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার উন্নতি হলে এক মাস পর গত ৩ জুন চিকিৎসকদের পরামর্শে খালেদা জিয়াকে কেবিন ফিরিয়ে আনা হয়। এ সময় দু’দফা খালেদা জিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। পরে তার জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসে। গত ১০ এপ্রিল গুলশানের বাসা ফিরোজায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতায় খালেদা জিয়ার ফুসফুস, হার্ট, লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হয়েছে। হৃদরোগের কারণে তার শরীরের যে কোনো একটি চেম্বার বা অংশে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে লিভার ও কিডনি প্রায় অর্ধেক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার লিভার ট্রান্সপান্টেশনের (প্রতিস্থাপন) সুপারিশ করেছেন চিকিৎসকরা।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক এএফএম সিদ্দিকী বলেছেন, আমরা একটা লেভেল পর্যন্ত তার চিকিৎসাটা চালিয়ে কতগুলো জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু কতগুলো বিষয় আছে, যেমন তার যে লিভারের সমস্যা আমরা ধরতে পেরেছি, সেটা কোন স্টেজে আছে এবং এমন সব সেন্টারে এসব অ্যাসেসমেন্ট হওয়া উচিত, যেখানে আর্টিফিশিয়াল লিভার সাপোর্ট, আর্টিফিশিয়ালি অন্যান্য অ্যাডভান্স টেকনোলজি অ্যাপ্লাই হতে পারে।
অসুস্থতা কিন্তু শুধু লিভারে থাকে না, খাদ্যনালীতে হয়, যেটা পরে সারা শরীরে গিয়ে প্রভাব ফেলে। যেটাতে মেজর কতগুলো কমপ্লিকেশন হতে পারে। সেই ধরনের টেকনোলজি বা সেই ধরনের অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট সাপোর্ট আমাদের বাংলাদেশে নেই বলে আমরা মনে করছি। আমাদের লিখিত প্রতিবেদনে সেটা আমরা বলেছি।