বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল ব্যবসায় শৃঙ্খলা এনে ভোক্তার আস্থা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য নতুন যে নির্দেশনা জারি করেছে তার মাধ্যমে সরকার ই-কমার্স ব্যবস্থাপনা আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ এর বিধানমতে এ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে অনলাইনে এবং সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নানা ধরণের পণ্য কেনাকাটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে গত দেড় বছরে করোনা সংক্রমণের সময়ে অনলাইন বাজার আরো রমরমা হয়েছে।
তবে নানা সময়ে অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়া, সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করেও পণ্য বুঝে না পাওয়া সংক্রান্ত নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে।
ফারিয়া তাবাস্সুম নামে একজন বলছেন মাস দুয়েক আগে তিনি একটা অনলাইন পেজ থেকে পোশাক অর্ডার করেন। কিন্তু হাতে পাওয়ার পর দেখতে পান এটা অরিজিনাল ব্র্যান্ডের রেপলিকা।
তিনি বলেছেন, আমি একটা নির্দিষ্ট ব্রান্ডের পোশাক অর্ডার করেছিলাম। তাদের কাছে অর্ডার করার সময় এটাও জানতে চেয়েছিলাম অরিজিনাল কী না। তারা জানিয়েছিলো অরিজিনাল। কিন্তু হাতে পাওয়ার পর দেখলাম সেটা রেপলিকা।
তিনি আরো অভিযোগ করেছেন, তাদের ডেলিভারি চার্জ দিয়েছিলাম তারপর তারা সেটা পাঠিয়েছে কুরিয়ারের মাধ্যমে। এবং সেই কুরিয়ারের সার্ভিস চার্জ আমাকে দেয়া লেগেছে। আমি যখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম,তারা কোন উত্তর দেয়নি। আমি তাদের পেজে যেয়ে রিভিউ দিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমার সেই রিভিউটা ডিলিট করে দেয় পেজ থেকে। ড্রেসগুলো এখনো পড়ে আছে, ব্যবহার করা হয়নি। আবার অগ্রিম টাকা চেয়ে অনেক অনলাইন বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করে থাকেন। সেক্ষেত্রে নানা ঝামেলা পোহাতে হয় ক্রেতাদের।
এই ধরনের নানা অভিযোগ করে থাকেন ক্রেতারা। আবার বিক্রেতারা নির্দিষ্ট সময়ে, ঠিকানায় পণ্য ডেলিভারি দিয়ে সেটা নেয়ার লোক পান না, এমন অভিযোগও রয়েছে। এখন সরকার যে নির্দেশিকা জারি করেছেন সেখানে এই ধরনের বিপত্তি এড়াতে কী করনীয় সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।
পণ্য ডেলিভারি
পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে সরকার যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছে সেখানে বলা হচ্ছে:
* বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা পণ্য সামগ্রী ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার নিকট হস্তান্তর করতে হবে এবং ক্রেতাকে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএস এর মাধ্যমে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে ডেলিভারি সংস্থা বা মার্কেটপ্লেস ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে।
* পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়ে থাকলে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি প্রদান করতে হবে।
* নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে ডেলিভারির সময় আরও সংক্ষিপ্ত হবে এবং ক্রেতাকে তা ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময় সুস্পষ্টভাবে অবহিত করতে হবে।
* কোন একটি ক্রয়াদেশ (purchase order)-এ একাধিক পণ্য থাকলে আলাদা আলাদা পণ্যের জন্য সাধারণত আলাদা আলাদা ডেলিভারি চার্জ আরোপ করা যাবে না। তবে মার্কেটপ্লেসে পণ্যে আলাদা আলাদা ডেলিভারি প্রদান করা হলে আলাদা আলাদা চার্জ গ্রহণ করা যাবে। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করার সময় বা ইনভয়েসে পূর্বেই অবহিত করতে হবে।
* পণ্য বিক্রয় ও সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কেটপ্লেসে প্রদর্শিত পণ্যের মান ও সঠিকতা মার্কেটপ্লেসের স্বত্বাধিকারীকে নিশ্চিত করতে হবে। তবে বিক্রেতা বা মার্চেন্ট’র সঙ্গে ভিন্নতর চুক্তি থাকলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
*সময়মত ডেলিভারি প্রদান এবং মালামালের সুরক্ষার জন্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান বা ডেলিভারি পারসন’র সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদন করবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে।
* পণ্য সরবরাহের সময় মুদ্রিত বিল প্রদান করতে হবে যাতে প্রদেয় বা প্রদত্ত ভ্যাট ও আয়কর (যদি থাকে) উল্লেখ থাকতে হবে।
* যেসব পণ্যের ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি আছে, তার জন্য ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি পিরিয়ড ও সেবা প্রাপ্তির স্থান ও যোগাযোগের বিস্তারিত ঠিকানাসহ অন্যান্য শর্ত সম্বলিত কার্ড বা ডিজিটাল কার্ড পণ্যের সঙ্গে সরবরাহ করতে হবে।
* পচনশীল দ্রব্য দ্রুততম সময়ে ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ডেলিভারির সময় যাতে পণ্যের কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য মার্কেটপ্লেস কর্তৃপক্ষ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অভিযোগ ও প্রতিকার
* পণ্য ও সেবার বিষয়ে অভিযোগের জন্য মার্কেটপ্লেস কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অভিযোগ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপ বা প্ল্যাটফর্মে ফোন নম্বর, ইমেইল বা অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রতিটি ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানে একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার নিয়োগ দিতে হবে যিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারে।
* কোন পণ্যের বা সেবা প্রদান বিষয়ে ক্রেতার অভিযোগ রেকর্ডের যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং যেকোন অভিযোগ প্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধানের ব্যবস্থা করে ক্রেতাকে ফোন, ই-মেইল বা এসএমএস’র মাধ্যমে তা জানাতে হবে।
* পণ্যের বা সেবার বিষয়ে ক্রেতা বা অন্য কারও রেটিং এবং মতামত জানানোর ব্যবস্থা ওয়েবসাইট, অ্যাপ কিংবা প্ল্যাটফর্মে রাখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে ক্রেতারা পণ্যের ব্যাপারে অন্য ক্রেতাদের মতামত বা রিভিউ দেখে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান (মার্কেটপ্লেস বা মার্চেন্ট) বা এর কোন স্টাফ বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা মার্চেন্ট’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ রিভিউর বা রেটিং এ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এ রিভিউ মুছে ফেলা যাবে না।
* সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারণে (Force majeure) ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব না হলে, অর্ডার দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্রেতাকে তা ফোন, এসএমএস, ই-মেইল বা অন্যান্য মাধ্যমে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত প্রদান করতে হবে এবং অন্য কোন পণ্য ক্রয় করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্য করা যাবে না।
* এ নির্দেশিকার বিধান প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষ বিক্রেতা বা মার্কেটপ্লেস’র ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট নিবন্ধন ইত্যাদি বাতিল করাসহ সংশ্লিষ্ট মার্কেটপ্লেস নিষিদ্ধকরণসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিকারের জন্য প্রেরণ করতে পারবে।
* এ নির্দেশিকা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্রেতা বা কোন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আইনানুগ প্রতিকারের জন্য অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।
* ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুষ্ঠুভাবে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করবে।
অগ্রিম পরিশোধিত মূল্য সমন্বয়
ক্রেতা কোন মাধ্যমে (ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং, অন্যান্য) অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে এবং বিক্রেতা কোন কারণে নির্ধারিত সময়ে সে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ ১০ দিন (সংশ্লিষ্ট অর্থ প্রদানকারী মাধ্যমের ব্যবহৃত সময় ব্যতীত) এর মধ্যে ক্রেতার পরিশোধিত সম্পূর্ণ অর্থ যে মাধ্যমে ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করেছেন সেই একই মাধ্যমে (ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ইত্যাদি) ফেরত প্রদান করতে হবে।
এক্ষেত্রে কোন চার্জ থাকলে মার্কেটপ্লেস বা বিক্রেতাকে তা বহন করতে হবে। মূল্য ফেরতের বিষয়ে ক্রেতাকে ইমেইল, এসএমএস, ফোন বা অন্য মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতার পরিশোধিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা যাবে না। ক্রেতা যথাসময়ে পণ্য বা সেবা গ্রহণে ব্যর্থ হলে এ সময়সীমা শিথিল করা যাবে।
নির্দেশনার লক্ষ্যে বলা হয়- ডিজিটাল ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে ‘জাতীয় কমার্স নীতিমালা (সংশোধিত) ২০২০ এর সফল বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা।
এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা উল্লেখ করা হয়- ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; ডিজিটাল ব্যবসার প্রসারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
এদিকে ই-কর্মাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম সচিব নাসিমা আকতার জানিয়েছেন তারা সরকারের এই নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এই নির্দেশনাগুলো দরকার ছিলো। এই সেক্টরটা স্থিতিশীল হওয়া দরকার। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কারণে অনলাইনে কেনাকাটা করতে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সেটা আশা করছি ফিরে আসবে।