বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিকেরাও। বিশ্বের ১৮০ সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে।
রোববার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানসহ ১৭টি সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রথম এ তথ্য পায়। পরে তারা বিষয়টি ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করে।
গার্ডিয়ান বলছে, বিশ্বজুড়ে যে ১৮০ সাংবাদিকের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছেন সম্পাদক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বিটে কর্মরত সাংবাদিকেরা। আছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, আল–জাজিরা, ফ্রান্স ২৪, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, মিডিয়াপার্ট, অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি), ব্লুমবার্গ, এএফপি, ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকাসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা।
নাম পাওয়া গেছে লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সম্পাদক রৌলা খালাফের। গত বছর ইতিহাস গড়ে সংবাদপত্রটির প্রথম নারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
অনুসন্ধানকারীরা ধারণা করছেন, ২০১৮ সাল থেকেই খালাফের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। ওই সময় তিনি পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। এর পেছনে জড়িত থাকতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।
এ বিষয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ এবং সাংবাদিকদের ওপর যেকোনো ধরনের বেআইনি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কিংবা নজরদারি অগ্রহণযোগ্য।’
২০১৯ সালে আজারবাইজানের অনুসন্ধানী সাংবাদিক খাদিজা ইসমায়িলোভার স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে বলে জানান অনুসন্ধানকারীরা। দেশটির স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও তার মিত্রদের দুর্নীতি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করেছেন। এর আগেও তিনি নিজ দেশের স্বৈরাচারী শাসকের দমনপীড়ন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন।
এ বিষয়ে খাদিজা বলেন, ‘আমি সেসব দেশের সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, যারা এসব নজরদারির যন্ত্র বানিয়েছে এবং ইলহাম আলিয়েভের মতো খারাপ শাসকদের কাছে বিক্রি করেছে। এটা ঘৃণ্য, এটা জঘন্য কাজ।’
যেসব সাংবাদিকের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, সেই সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছে আমেরিকান অনুসন্ধানী সাংবাদিক ব্রাডলি হোপের নাম। তিনি লন্ডনে বসবাস করেন। তার ফোনে যখন আড়ি পাতা হয়েছিল, তিনি তখন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে কর্মরত ছিলেন।
ব্রাডলি হোপ ও তার সহকর্মী টম রাইট মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আলোচিত ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি ও এর সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পৃক্ততা নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আগে থেকেই জানতাম, যেকোনো সময় একটি দেশ আমার ফোনে আড়ি পাততে পারে।’
ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি করা স্পাইওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, এমনকি কোনো কোনো দেশে ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও আড়ি পাতা হয়েছে। মূলত কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সরকার আড়ি পাতার কাজে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে।
পেগাসাস হলো একটি ম্যালওয়্যার। এটি ব্যবহার করে আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সব মেসেজ, ফটো, ই–মেইল, কল রেকর্ড জানা যায়। এ ম্যালওয়্যার ফোন ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতেই মাইক্রোফোন চালু করে দেয়। অনুসন্ধানকারীদের হাতে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বর এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসও-এর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে।
এদিকে, ফোনে আড়ি পাতার এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমসমূহে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলেও এক বিবৃতিতে এনএসও জানিয়েছে, পেগাসাস ব্যবহার করে আইনবহির্ভূত নজরদারির যে অভিযোগ উঠেছে তা অনুমাননির্ভর ও ভিত্তিহীন এবং এনএসও কোনো ‘অন্যায়’ কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়।
বিবৃতিতে এনএসও কর্তপক্ষ বলেছে, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে নজরদারির জন্যই এটি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে কোম্পানির কাছে তথ্য রয়েছে এবং যেসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত ও সন্তোষজনক, সেসব দেশের সেনাবাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ পেগাসাস ব্যবহার করে।