বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এসএমই খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৭৭ শতাংশ। আর বড় ঋণ তথা শিল্প ও সার্ভিস খাতের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই বিতরণ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে কৃষি খাতের জন্য ঘোষিত প্রণোদনার প্রায় ৯০ শতাংশ বিতরণ করা হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত যে গ্রাহকের জন্য ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার পুরোটা পেয়েছে, অথবা ঋণ নিয়েও সঠিক কাজে ব্যবহার হয়েছে কিনা- এর উত্তর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নেই।
এসব তথ্য জানার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাস বাংলাদেশে এখন মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের গলাগলি করে চলার মতো অবস্থা। প্রতিদিন গড়ে ২৫০ প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। বাবাকে সন্তান, সন্তানকে মা বা বাবা, স্বামীকে স্ত্রী বা স্বামী দাফন করে অথবা বাসায় আক্রান্ত রেখে জীবনযুদ্ধে বের হচ্ছেন। হয়তো নিজেই আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে থেমে যাওয়া জীবিকার হিসাব করছেন।
একদিন বা দুদিন নয়, এক মাস দু’মাসও নয়। ১৫ মাস ধরে এই ভয়ংকর অদৃশ্য মৃত্যুদূত জীবনকে তাড়া করে ফিরছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কখনো একটু থেমেছে, কখনো একটু বেড়েছে। মৃত্যুদূত কখনো পিছু ছাড়েনি।
ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, উৎপাদন বিপণন সবকিছু প্রায় বন্ধ। আমদানি-রপ্তানি উৎপাদন কিছুটা চললেও অভ্যন্তরীণ ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলো থেমে গেছে।
এদিকে করোনার এই গভীর অভিঘাত রোধে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঘোষণা করেছে প্রণোদনা। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। পরে দুই দফায় এর আওতা বৃদ্ধি করে ৪০ হাজার কোটি টাকা করে। গ্রাহকপর্যায়ে এর সুদহার নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ৪ শতাংশ।
এর বাইরে এসএমই ও কৃষি খাতের জন্য আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে এর সুদ নির্ধারণ করা হয় ৪ শতাংশ। শিল্প ও সার্ভিস তথা বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করার কয়েক মাসের মধ্যে বরাদ্দ অনুমোদন হয়। কিন্তু এসএমই খাতের ঋণ এখন পর্যন্ত প্রায় এক-চতুর্থাংশ থেকে গেছে। যেটা বিতরণ হয়েছে সেটা নিয়েও কথা উঠেছে।
খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাহলে কি ছোট ঋণের নামে শিল্প ও সার্ভিস খাতের উদ্যোক্তারা প্রণোদনা নিয়ে গেছেন? অথবা প্রনোদনা যে কাজে ব্যবহারের জন্য নেওয়া হয়েছে আদৌ সেই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে? ছোট্ট ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের অভিযোগ- এসএমই খাতের নামে যে প্রণোদনা বিতরণ হয়েছে, তার তিন-চতুর্থাংশ অন্য খাতে চলে গেছে।
এসএমই খাতের জন্য বরাদ্দ করা হলেও নানারকম শর্তের জালে ছোট্ট ও মাঝারি খাতের উদ্যেক্তারা তা নিতে পারেননি। ফলে করোনা মহামারীর আভিঘাতে যে এমএমই খাত কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগারে ভূমিকা রাখে, করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে সেই খাত ঋণ পায়নি।
ফলে অন্যান্য শিল্প ও সেবাখাত করোনার মধ্যে অনেকটা ঘুরে দাঁড়ালেও এসএমই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রাস্তার ধারের দোকানদার, ছোট্ট ছোট্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা নানারকম উপকরণ তৈরি করার স্বল্পপুঁজির ব্যবসা দাঁড়াতে পারেনি। পল্লী অঞ্চলের ছোট্ট ছোট্ট খামার, কৃষি উদ্যোগ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।
করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের স্বল্পসুদে যে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রণোদনার হিসাবে দেওয়া হয়েছে, এ ঋণের মোট সুদের অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে দিয়েছে সরকার। জনগণের করের টাকা থেকেই এ ভর্তুকি দেওয়া হয়।
ঋণ দেওয়ার প্রায় এক বছর পর গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ঋণের ব্যবহার খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য কারা ঋণ নিয়েছেন ও ঋণের ব্যবহার কোথায় হয়েছে, তার তথ্য চাওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে।
ঋণ নিয়ে সঠিক কাজে ব্যবহার করেছে কিনা, যে কাজের জন্য ঋণ নিয়েছে সেই কাজে ব্যবহার করছে কিনা-শেয়ার বাজার বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করছে কিনা, এটা দেখার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ।
এর ফলে প্রণোদনার কোয়ালিটি ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তবে শিল্প ও সার্ভিস এবং এসএমই খাতের প্রণোদনা ডেফিনেশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট করে বিতরণ করা হয়েছে।