করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় অবস্থা বিরাজ করছে। থমকে গেছে জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি-সবকিছু। এ ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। বিশেষ ব্যবস্থা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও করোনার ঘা থেকে দূরে রাখা যায়নি। নতুন শাখা খোলার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত লেগেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পুরোপুরি করোনা মহামারীর মধ্যে এক বছর ৪ মাসে নতুন শাখা খোলা হয়েছে ১৯৬টি। আগের বছরের একই সময়ে শাখা খোলা হয়েছিল তিন শতাধিক।
করোনার মধ্যে এক বছরের ব্যবধানে নতুন শাখা খোলা কমেছে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে যখন করোনায় আক্রান্ত শুরু হয় তখন সারা দেশে ব্যাংকের শাখা ছিল ১০ হাজার ৫৯২টি। এর মধ্যে শহরে ছিল পাঁচ হাজার ৫৬৫টি। আর পল্লী অঞ্চলে শাখা ছিল পাঁচ হাজার ২৭টি। ২০২১ সালের জুন মাসে শাখার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৮৮টি। এর মধ্যে শহরে বেড়েছে ৮৭টি। আর গ্রামে বেড়েছে ১০৯টি। গ্রামের তুলনায় শহরে শাখা কম খোলা হয়েছে।
করোনা মহামারির সময় মানুষের চলাফেরায় বাধা নিষেধে পড়েছে। কয়েক দফায় লকডাউন দেওয়া হয়। উৎপাদন, বিপণন, যোগাযোগ, ভোগ- সবকিছুতে আঘাত লাগে। মানুষ কর্ম হারায়। কমে যায় আয়-রোজগার, সঞ্চয় ও আমানত। কমে যায় ব্যাংকে লেনদেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জরুরি কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৬২৮ জন। আর মারা যায় ২৫ হাজার ৭৫৯ জন মানুষ। করোনা মহামারীকালীন সময়ে মানুষের কাছে জীবন বাঁচানোই প্রধান কাজে পরিণত হয়।
করোনার এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার প্রথম দফায় প্রায় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা স্কিম ঘোষণা করে। যাতে ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি, কৃষি সচল থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। এত ব্যবস্থা নেওয়ার পর অর্থনীতিতে বিপর্যয় রোধ করা যায়নি। অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কল-কারখানা।
এতে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে প্রায় কোটি মানুষ বেকার হয়ে যায়। নতুন করে আরও দরিদ্র হয়ে যায় ১০ শতাংশের অধিক মানুষ। এ সময় ছোট্ট ছোট্ট উদ্যোগ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দেড় বছরের অধিক সময় এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
এর প্রভাব পড়ে ব্যাংক লেনদেনে। এতে ব্যাংকের শাখা খোলার ক্ষেত্রে যে স্বাভাবিক গতি ছিল তা কমে যায়। গত বছর যে হারে ব্যাংকের শাখা খোলা হয়, করোনা কালে তার চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ শাখা খোলা কমে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ব্যাংকের কার্যক্রম অর্থনীতির ছায়ার মতো। অর্থনীতি যেমন থাকে ব্যাংকিংয়ে সেভাবেই প্রতিফলিত হয়। করোনাকালে অর্থনীতি যেভাবে স্পন্দিত হয়েছে ব্যাংকিংও সেভাবেই সাড়া দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে যেভাবে ‘কোরামিন’ দিয়ে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে ব্যাংকিং সেভাবে চলছে। নতুন করে ব্যবসা-বাণিজ্য কেউই বাড়াতে পারেনি। এ জন্য নতুন শাখা খোলা কমবে এটাই স্বাভাবিক। বরং অর্থনীতি যে হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাখা খোলার চিত্র বলে ব্যাংকিং খাত সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
করোনাকালে প্রণোদনা ও বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখার কারণে কৃত্রিম মুনাফা হয়েছে। এ মুনাফা প্রকৃত অর্থে যে মুনাফা তা নয়। শাখা খোলার ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়েছে- এটা করোনাকালীন সময়ে চিত্রের কাছাকাছি, প্রকৃত চিত্র নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। করোনা পরবর্তী স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকের খারাপ অবস্থা ফুটে উঠবে।