0 Comments

চ্যারিটি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান কিংবা ট্রাস্ট অসহায় মানুষের কল্যাণে গঠিত হলেও এর আড়ালে সম্পদের সুরক্ষা ও কর ফাঁকির অভিযোগও বিস্তর। সহজে কর ফাঁকি দেওয়া, এর আড়ালে লাভের অংশ নিজেদের পকেটে ভরা আর নানা কৌশলে খরচের খাত বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় চ্যারিটি আর ট্রাস্টের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

 

 

এসব চ্যারিটি ও ট্রাস্ট বিশেষ হারে কর দেওয়ার বাইরেও আলাদা করে করছাড় নিয়ে নীরবে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে বলেও সমালোচনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাস্ট ও চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানকে কর বিভাগের কঠোর নজরদারিতে আনার জোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশে কর ফাঁকি দেওয়া ও সম্পদ লুকানো বেশ সহজ। একদিকে কর বিভাগের সক্ষমতার অভাব, অন্যদিকে এ বিভাগের কিছু দুর্নীতিবাজ চক্রকে ‘ম্যানেজ’ করে কর ফাঁকি চলে অহরহ। বিরাট কর ফাঁকির খুব সামান্যই করের আওতায় আনা সম্ভব হয়। এ জন্য বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাতও বিশ্বে প্রায় সবার চেয়ে কম।

তবে সাধারণ কর ফাঁকির পাশাপাশি অনেক ব্যক্তি মানব কল্যাণে চ্যারিটি ও ট্রাস্ট গঠন করে থাকেন। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সৎ হলেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এর আড়ালে সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া বা কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও কম নয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্ট বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সম্পদ বেড়ে গেলে তা থেকে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা কৌশল নেওয়া হয়। কখনো সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর থেকে করছাড় নেওয়া হয়।

কখনো তদবির করে ন্যূনতম কর হার কার্যকর করা হয়। তা ছাড়া জমানো টাকা ব্যাংকে রেখে তা থেকে যে লভ্যাংশ হয়, সেটি নিজেদের পকেটে পুরতে খরচ বাড়িয়ে দেখানো হয়। কখনো নিজেদের লোকজনকে বিভিন্ন দায়িত্বে বসিয়ে বেতন ভাতা নেওয়ার মাধ্যমে টাকার খরচ দেখানো হয়। এসব কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব প্রতিষ্ঠান অলাভজনক হলেও দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

এই লাভের অংশ সরাসরি নেওয়া সম্ভব নয় বলে নানা ছুতায় তা নিচ্ছেন এর ট্রাস্টিরা। কখনো সম্মানী বা গাড়ির নামে কখনো বা অন্যান্য খরচের আড়ালে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট ফান্ডে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখতে হয়। এর উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত মানের পড়াশোনা, ল্যাব, অবকাঠামো, গবেষণা খাতে ব্যয়ের সামর্থ্য বাড়ানো। তবে ট্রাস্টের টাকায় হরিলুটের খবর নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ট্রাস্ট থেকে টাকা মেরে দেন।

ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘ট্রাস্ট গঠন করলে আয়কর ও ভ্যাট মওকুফ নেই। ট্রাস্ট-ফাউন্ডেশন হলো চ্যারিটি। এসব থেকে মুনাফা নেওয়া যাবে না। আমাদের দেশে সব ধরনের ব্যবসায় আয়কর ও ভ্যাট আছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দিচ্ছে। আমার প্রতিষ্ঠান কোনো কর ফাঁকি দেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে কর ফাঁকির প্রবণতা আছে। সরকারের যে করহার তাতে এই প্রবণতাও স্বাভাবিক। ’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘কম্পানির করহার ও ট্রাস্টের আয়ের ওপর যে করহার নির্ধারিত আছে, তার মধ্যে পার্থক্য অনেক। তাই কম্পানির আয় কম দেখিয়ে ট্রাস্টের আয়কর বড় করে দেখালে আয়কর অনেক কম দিতে হয়। সাদা চোখে কম্পনিগুলো ট্রাস্টের আড়ালে বিভিন্ন অনিয়ম করে। অনুদান-ফান্ড সংগ্রহ-বিনিয়োগ করে সেই টাকার কিছু অংশ জনকল্যাণে ব্যয় হিসেবে দেখায়। এতে নিট আয় কমে যায়। কর ফাঁকি দিতে সুবিধা হয়। ’

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাস্ট সুদ, ভাড়া, রয়্যালিটি থেকে আয় করলে তাকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আদলে কর দিতে হয়। যুক্তরাজ্যে চ্যারিটি কমিশনের অধীনে থাকা ব্রিটিশ ট্রাস্টগুলোকে সুদের আয় বাধ্যতামূলকভাবে জনকল্যাণে ব্যয় করতে হয়। বার্ষিক হিসাব ও অডিট রিপোর্ট দাখিল বাধ্যতামূলক। অনিয়ম ধরা পড়লে ট্রাস্টের অনুমোদন ও করছাড় বাতিল হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় চ্যারিটেবল ট্রাস্ট করমুক্ত, তবে সুদসহ সব আয় জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হয়। এর ব্যতিক্রম হলে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আয়ের ৮৫ শতাংশ জনহিতকর কাজে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক।

অন্যদিকে বাংলাদেশে চ্যারিটেবল ট্রাস্টগুলো বিভিন্ন ধরনের কর অব্যাহতি পায়। আয়কর আইন অনুযায়ী, কোনো ট্রাস্ট ধর্মীয়, শিক্ষামূলক বা জনহিতকর উদ্দেশ্যে গঠিত হলে তার আয়ের (যেমন বাড়িভাড়া, অনুদান, ব্যাংক সুদ) ওপর ক্ষেত্রবিশেষে করছাড় আছে। এই কাঠামোর মূল উদ্দেশ্য ছিল অলাভজনক খাতকে উৎসাহ দেওয়া এবং জনহিতকর কাজে অর্থ যেন বেশি ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করা। অনেক ধনী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী শুধু কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট গঠন করছেন ও সেখান থেকে মোটা অঙ্কের ব্যাংক সুদ পাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে এ থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাস্টের আয়, বিশেষ করে ব্যাংক সুদ ও কার্যক্রমভিত্তিক আয়ের আলাদা করনীতির বিধান করা। জনকল্যাণে ব্যয় না হলে সুদে কর আরোপ করা। ব্যাংক আয় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে জনকল্যাণে ব্যয় বাধ্যতামূলক করা। প্রতিবছর আর্থিক প্রতিবেদন ও অডিট বাধ্যতামূলক করা। ট্রাস্ট যদি সম্পদ গচ্ছিত রাখে বা মূলত কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে গঠিত হয় তাহলে তার করমুক্ত সুবিধা বাতিল করে জরিমানা করা।

রাজস্ব খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, নীরবে ট্রাস্ট ও চ্যারিটির আড়ালে যেসব প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে, তাদের কর বিভাগের কঠোর নজরদারিতে আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিষদ নিরীক্ষা পরিচালনা করে কর ফাঁকি ও অনিয়ম ধরা পড়লে হ্রাসকৃত হারে কর দেওয়া ও করছাড়ের যে সুবিধা নিয়েছে, তা বাতিল করা হোক। করের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে হলে ও রাজস্ব বাড়াতে হলে কর বিভাগকে এসব সংস্কার করতে হবে। তাদের মতে, অনেক ট্রাস্টের বিপুল অঙ্কের অলস টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগেরও সুযোগ রাখা যায়। যেখান থেকে মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে এবং সরকারও রাজস্ব পাবে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts