করোনা মহামারিতে শেষ বিদায়ের বন্ধু করোনা মহামারিতে শেষ বিদায়ের বন্ধু – Sabuj Bangla Tv
  1. shahinit.mail@gmail.com : admin :
  2. khandakarshahin@gmail.com : সবুজ বাংলা টিভি : সবুজ বাংলা টিভি
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন
নোটিশ-
বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন টিভি চ্যানেল সবুজবাংলা টিভি এর জেলা/উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে...

করোনা মহামারিতে শেষ বিদায়ের বন্ধু

সবুজ বাংলা টিভি
  • প্রকাশ কাল | রবিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২১
  • ৫০৭ পাঠক

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ সার্বজনীন এই কথাটি যেন অসাড় প্রমাণিত হচ্ছিল করোনা ভাইরাসের মহামারিতে। করোনার ভয়ে রক্তের শক্ত বন্ধনও ছিড়ে গিয়েছিল। করোনায় কেউ আক্রান্ত হলেই আতংকে তার আপনজনরা দূরে সরে যেতেন। বিশেষ করে করোনায় কারো মৃত্যু হলে তার দাফন-কাফনের জন্যও আপনজনরা কাছে আসতেন না!

এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের কয়েকজন তরুণ বুকে অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন। তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় মানুষের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন। এই অদম্য সাহসী তরুণরা করোনা মহামারিতে কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে করোনায় আক্রান্ত মানুষের দাফন-কাফন ও অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিতে নতুন এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার নাম রাখা হয় ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু।’

গত বছর দেখা গিয়েছে, কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে, মৃত ব্যক্তিকে দাফন-কাফন করার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। মৃত ব্যক্তির আপনজনরা তখন দাফন-কাফন করার জন্য এগিয়ে আসেনি। এক অমানবিক মানব সমাজের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে ওই সময়। বিশ্বের মানব ইতিহাসের এমন ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে মুক্ত ছিল না চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকাও।

এই মিরসরাই এলাকাতেও তখন ভয়াবহ করোনা ভাইরাস আতংক, চারিদিক থেকে আসতে থাকে স্বজন হারানোর শোক সংবাদ। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে জীবনের শেষ মুহূর্তে পরিবারের আপন মানুষগুলোর অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণের খবরও আসতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাওয়ার পর শরীয়ত সম্মতভাবে জানাজা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। মৃতদের গোসল ও দাফন কাফনে চরম অনিশ্চয়তার খবর আসে।

এমন দুর্যোগময় মুহূর্তে মিরসরাইয়ে আশার আলো ছড়ায় একটি সংগঠন, যার নাম ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’। ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। মৃত ব্যাক্তির গোসল ও দাফন-কাফন এবং আর্তমানবতার কল্যাণে কাজ করা এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গত এক বছর ধরে নিরলস এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটির সদস্যরা।

আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত এই সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা মিরসরাই প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক নুরুল আলম সারাক্ষণকে বলেন, ‘একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চোখ আটকে যায় একটি খবরে। খবরটি হলো, করোনা সন্দেহে টাঙ্গাইলের সখীপুরের বনে মাকে ফেলে গেলেন সন্তানেরা। ফেলে যাওয়ার সময় তারা বলে মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’ এ কথা বলে বৃদ্ধা মাকে শাল-গজারির বনে ফেলে যান তার সন্তানেরা। তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহে সন্তানেরা তাদের মায়ের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করেন।। এ খবরটি পড়ে বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে রশি বেঁধে গোসল ছাড়া লাশ কবরে রাখার দৃশ্য দেখে আরো খারাপ লাগতে থাকে। সেই ভাবনা থেকে ওয়ার্লেস দারুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ মাওলানা শোয়াইব সাহেবের সঙ্গে একটি সংগঠন গঠন করার প্রস্তাব করি। তিনি লাশ গোসল, জানাজা ও দাফন-কাফনে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এরপর কমফোর্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়ার্লেস দারুল উলুম মাদ্রাসায় অস্থায়ী কার্যালয় থেকে শুরু হয় নতুন সংগঠন ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’র পথচলা। পরবর্তী সময়ে জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সম্পৃক্ততায় এবং সহযোগিতায় সংগঠনটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যারা জীবনের ঝুঁকি, সামাজিক হুমকি উপেক্ষা করে লাশের গোসল, দাফন- কাফন করেছেন, এদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা ওমর ফারুক, কারি নোমান, মাওলানা মোশাররফ হোসেন, মাওলানা আবদুল মান্নান, অ্যাম্বুলেন্স চালক মেহেদী হাসান, দারুল উলুম মাদ্রাসার কেয়ারটেকার এরাদুল হক (চাঁন মিয়া)। এছাড়াও সংগঠনটির অগ্রযাত্রায় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন, এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ডা. এস এ ফারুক, কাস্টমস কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী, মাজহার উল্লাহ মিয়া, মীর আলম মাসুক, ফখরুল ইসলাম খান ( সিআইপি), চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন, চেয়ারম্যান এমরান উদ্দিন, রাসেদ খান চৌধুরী, আশরাফ উদ্দিন সোহেল, সাইফুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন রুবেল, এ জেড সাইফুল ইসলাম টুটুল, ও সলিম উল্লাহ। এছাড়াও দেশে বিদেশেরে অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী, দেশ বিদেশের সব সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সর্বোচ্চ পরিষদ, স্থায়ী পরিষদ ও র্কাযনির্বাহী পরিষদের সব সদস্যরা এম্বুলেন্স, অক্সিজেন ও কবরস্থান সহায়তা তহবিল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সংগঠনের সেবার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করেছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের মাটির ব্যাংকের সঞ্চিত টাকা, জন্মদিনের অনুষ্ঠানের টাকা মানবিক তহবিলে দিয়ে করোনাকালে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। প্রবাসিরা অ্যাম্বুলেন্স তহবিলের জন্য নিজে শ্রম দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত টাকা কালেকশন করে পাঠিয়েছেন। সর্বোপরি এ সংগঠনের সকল কাজের দিকনির্দেশনায় রয়েছেন, হাফেজ মাওলানা শোয়াইব (প্রধান ধর্মীয় পরামর্শক), আলহাজ নিজাম উদ্দিন সমন্বয়ক (সেবা) ও আশরাফ উদ্দিন সোহেল ( সমন্বয়ক হিসাব ও অর্থ)।

মানবিক এই সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা নুরুল আলম জানান, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানবিক তাড়নায় করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনে ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’র মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় ১৮টি ইউনিট গঠিত হয়। প্রতি ইউনিয়নে সাতজন পুরুষ ও পাঁচজন মহিলা নিয়ে মোট ১৮টি ইউনিটে ২১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের আলেম ওলামা দ্বারা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে এই সংগঠন ইতোমধ্যে ৮৯ জন মৃত ব্যক্তির দাফন কাফন সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে করোনা পজেটিভ, করোনা সন্দেহভাজন ও স্বাভাবিক মৃত নারী-পুরুষকেও দাফন-কাফন করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, এই সংগঠন মনে করে, সেবার কোনো সীমা নেই। এ কারণে মিরসরাই, ফেনী, সেনবাগ, ছাগলনাইয়া, রামগড়, খাগড়াছড়িতে শেষ বিদায়ের বন্ধু’র সদস্যরা সেবা দিচ্ছেন। এমনো দিন ছিলো, রাত তিনটায় শেষ বিদায়ের বন্ধুরা লাশের গোসল, দাফন-কাফন করে নিজ ঘরে থাকতে পারেনি, নিজ গ্রামেও আসতে পারেনি। একদিকে পরিবারের লোকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়, অন্যদিকে সমাজের একশ্রেণির মানুষের করোনার লাশ দাফনের অজুহাতে স্বপরিবারে গ্রাম ছাড়া করার হুমকির ভয়। তবুও রাত-দিন নিস্তব্ধ জনপদে এম্বুলেন্স আর কাফনের কাপড় নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকতো শেষ বিদায়ের বন্ধুরা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর পেলেই দাফন কাফনে ছুটে যেতো সংগঠনটির সদস্যরা। সেখানে গিয়ে প্রথমেই মরদেহের গোসল করিয়ে জানাজা শেষে পরম যত্নে কবরে রাখতো লাশ। অদূরে দাঁড়িয়ে অন্তিম যাত্রার সময় চোখের পানি ফেলতেন স্বজনেরা। আপন ছেলে হয়েও বাবার লাশ শেষবার ছুঁয়ে না দেখা, সন্তানের লাশ রেখে বাবা দূরে থাকা, গর্ভধারিনী মৃত মায়ের লাশের পাশে আসতে সন্তানের ভয়। এসব দৃশ্য ভোলার মতো নয়। এ সময় শেষ বিদায়ের বন্ধুরা সম্পূর্ণ বিনা খরচে নির্ভয়ে লাশের গোসল দিয়ে খাটিয়ায় তুলে নিজের কাঁধে তুলে দাফন কাফন সম্পন্ন করেন।

এই করোনা মহামারিতে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নুরুল আলম বলেন, ‘মিরসরাইয়ের ওসমানপুরের প্রবাসী ছালে আহমদের মৃত্যু এলাকার মানুষের বিবেকে নাড়া দিয়েছিলো। চট্টগ্রাম শহরে মারা যাওয়ার পর ফজরের পর লাশ মিরসরাইয়ের ওসমানপুর নিজ বাড়িতে আনার পর লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামার আগেই বাড়ির লোকজন পালিয়ে যায়। সারাদিন উঠোনে রোদে শুকিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পড়ে ছিলো লাশটি। দিন শেষে সন্ধার আগে খবর পেয়ে লাশ দাফন করে শেষ বিদায়ের বন্ধুরা। শেষ বিদায়ের বন্ধুরা যখন দাফন কাফনের কাজ শুরু করে তখন মানুষ ভরসা পায় মারা গেলে অন্তত ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক লাশের গোসল, দাফন-কাফন হবে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশে-বিদেশে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেষ বিদায়ের বন্ধুর নাম। চারিদিকে প্রশংসা আর ভালোবাসার উচ্ছ্বাস। এ ভালোবাসায় ভর করে আর্তমানবতার কল্যাণে বহুদুর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনটি।’

আমাদের সংবাদটি শেয়ার করুন..

এ পাতার আরও খবর

Sabuj Bangla Tv © All rights reserved- 2011| Developed By

Theme Customized BY WooHostBD