ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কেন্দ্রী সরকারের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ভোটযুদ্ধটা জমজমাট হবে বলেই ধারণা ছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামদের হটিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা বিজেপি এবার বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে। তৃণমূল নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হটানোর প্রকাশ্য ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষ নেতারা বারবার পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন।
কিন্তু করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও বৃহস্পতিবার অষ্টম দফার ভোট শেষে বুথফেরত জরিপ ভিন্ন আভাস দেয়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বুথফেরত তথ্যের ভিত্তিতে আরও দু-তিন দিন আগে থেকেই বলছিল, টানা তৃতীয়বারের মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের হাতেই থাকছে ক্ষমতার নাটাই। নিজের নির্বাচনী এলাকা নন্দীগ্রামে মমতা বিজেপির প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী তিনিই থাকছেন।
পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি আসনের মধ্যে প্রার্থীর মৃত্যুতে দুটি আসনে ভোট না হওয়ায় জরিপটা এমন ছিল, কোনও দল ১৪৮টি আসনে জয় পেলেই সরকার গঠন করতে পারবে। আর সেই দৌড়ে তৃণমূল কংগ্রেস জিতে নিয়েছে ২১৩টি আসন। বিজেপি পেয়েছে ৭৭টি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এতো দৌরঝাঁপের পরও তৃণমূল কংগ্রেসের এই নিরঙ্কুশ ও ভূমিধস জয়ের নেপথ্যে কী কারণ? বিজেপি নেতাদের মুখ থেকেই দলটির পরাজয়ের ৫টি কারণ তুলে এনেছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
এনডিটিভি অনলাইনে লেখা সত্যহিন্দ ডটকমের সম্পাদক ও লেখক আশুতোষ বিজেপির হারের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিক উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে মুসলিম ভোট আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়গুলো বিজেপির হারের ৫ কারণের মধ্যে বলা হয়েছে।
তবে আশুতোষের শক্ত যুক্তিটি হচ্ছে, রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলে সফলতা পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১. মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকেও নিজেকে ভিক্টিম বা ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরেন মমতা। বিপরীতে জনতার সামনে বিজেপিকে আগ্রাসী সেনা রূপে তুলে ধরেন। বোঝাতে চান, বিজেপি বহিরাগত। তারা যেকোনও মূল্যে রাজ্য জয় করতে চায়। মমতা সিআরপিএফ বা সিআইএসএফের সমালোচনা করে সময় নষ্ট না করে শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপির শীর্ষ নেতা অমিত শাহকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। জনতার সামনে বলেছেন, অমিত শাহ তাকে হারাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। শিতলকুচিতে সিআইএসএফের হাতে তৃণমূলের ৪ কর্মী নিহতের ঘটনা সেই বার্তাই দিয়েছে। রাজ্যে বিজেপির গোয়েন্দা ব্যবহার করে বাড়ি বাড়ি জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি মানুষকে মমতার পক্ষে নিয়ে এসেছে।
তৃণমূলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দিয়ে চড়াও হয়ে চেয়েছে বিজেপি। অভিষেকের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছৈ। মদন মিত্রের মতো নেতাদেরও একইভাবে আক্রমণ করা হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের নির্বাচনেও বিজেপি শারদ পাওয়ারের বিরুদ্ধে একই পন্থা অবলম্বন করেছিল, যা হিতে বিপরীত হয়েছিল। ঝানু রাজনীতিক মমতা এক্ষেত্রে নিজেদের ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরে ভোটারদের সহানুভূতি অর্জন করেছেন।
বিজেপি অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে হারের ৫ কারণ জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা:
২. মুখের অভাব। রাজ্য বিজেপি নেতারা প্রচার পর্বে অনেক পরিশ্রম করলেও কোনও মুখ তুলে ধরতে পারেননি। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই এ সিদ্ধান্ত ছিল। মোদী, অমিত শাহরা বারবার বাংলার ‘ভূমিপুত্র’ই মুখ্যমন্ত্রী হবে বলেও জানালেও আলাদা করে কারও নাম বলেননি। আর তৃণমূলের মুখ ছিলেন ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকা লড়াকু নেত্রী বাংলার মেয়ে মমতা।
৩. বাংলার কোনও নেতাকে মুখ হিসেবে ঘোষণা না করায় নীলবাড়ির লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে হয়। আর সেই নির্ভরতা দেখিয়ে বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ তকমা দেয় তৃণমূল। বিজেপি প্রাথমিকভাবে ভেবে নিয়েছে, তৃণমূলের এই আক্রমণকেই সমর্থন দিয়েছে বাংলার মানুষ।
৪. রাজ্য বিজেপি আরও একটি কারণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দলের উচ্চাভিলাষী বক্তব্য, ২০১৬ সালে বিজেপি মাত্র ৩টি আসনে জিতেছিল। সেখান থেকে একেবারে ক্ষমতায় আসার যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা দলের অভিজ্ঞতার তুলনায় অনেকটাই বেশি। লোকসভা নির্বাচনের ফলকে বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দেয়া ঠিক হয়নি। এটিও হারের বড় কারণ।
৫. ধর্মীয় মেরুকরণকে হাতিয়ার করে নীলবাড়ির লড়াইয়ে ফায়দা নিতে চেয়েছিল বিজেপি। প্রচারপর্বে অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তুলতে কড়া ভাষা প্রয়োগ করেন নেতারা। রাজ্য বিজেপি মনে করছে, এর ফলে মুসলিম ভোট এককাট্টা হলেও হিন্দু ভোটের সিংহভাগ নিজেদের পক্ষে আনা যায়নি।
আশুতোষ তার লিখায় জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের ২৭ শতাংশ ভোট মুসলিম। অনেকে এ সংখ্যা ৩০ শতাংশও বলেন। এজন্য মমতাকে ‘মুসলিম নেত্রী’ আখ্যা দিয়েও তেমন সুফল পায়নি বিজেপি। নির্বাচনী প্রচারণায় চণ্ডীপাঠ করে হিন্দুদের আস্থা ধরে রাখেন মমতা।
৬. বিজেপিতে ‘আদি ও নব্য’ বিবাদ রাজ্যে নিজেদের ঐক্যে ছিদ্র তৈরি করেছে। ভোটের আগে তৃণমূল থেকে এসে যারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তাদের বেশি প্রাধান্য দেয়াকে ভালো চোখে দেখেনি ভোটাররা। এছাড়া রাজ্যের সর্বত্রই প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ‘ভুল ছিল’ বলে রাজ্য নেতাদের বক্তব্য।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ তিন যুগের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়ে ক্ষমতায় বসে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬ সালেও ক্ষমতা ধরে রাখে তৃণমূল। ২০১৬ সালে ২৯৪ আসনের মধ্যে তৃণমূল ২১টি, বিজেপি ৩টি, কংগ্রেস ৪৪টি আর বাম ফ্রন্ট পেয়েছিল ৩২টি আসন।