করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারত আক্রান্তের সংখ্যায় আগেকার সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গত শুক্রবার নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত হিসেবে এই সংখ্যা পাঁচগুণ বেশি হতে পারে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, “এই ভাইরাস আমাদের এটাই দেখিয়েছে যে একে ছেড়ে দিলে, এটি সমাজে বিস্ফোরণ ঘটাবে”।
ফাউচি ভারতে সম্পূর্ণ লকডাউনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “আক্ষরিক অর্থেই লক ডাউন করুন, যাতে করে এই রোগ ছড়ানো বন্ধ করা যায়। কেউই দেশকে লক ডাউনে রাখতে চায় না, কিন্তু যদি কয়েক সপ্তাহের জন্য তা করেন, দেখবেন এই রোগ সংক্রমণের গতিতে এর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়েছে”।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, “গুরুতর ক্ষতি করার ব্যাপারে এই ভাইরাসের ক্ষমতাকে আপনি যদি স্বীকার না করেন, তা হলে নিজের জন্য সমস্যাই ডেকে আনবেন”।
বিপর্যস্ত ভারতকে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ রোধে কয়েক সপ্তাহের লকডাউনের পরামর্শ দিয়ে ফাউচি বলেন, এখনই লকডাউন না দিলে ভারতকে আরও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ভারতের করোনা সংক্রমণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, ভারতের পরিস্থিতি সত্যিই খুব ভয়াবহ। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এখনও ভারতে শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়নি। ফলে অবস্থা যে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই।
বিশ্বের কোভিড সমস্যার মোকাবিলা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোঅর্ডিনেটর গেল ই স্মিথ ওয়াশিংটনে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের কোভিড পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। আমি ভীষণ ভাবে উদ্বিগ্ন। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অথচ এখনও দেশটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এখনও শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়নি।
এদিকে, করোনাভাইরাসে বেসামাল দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত। দেশটি প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুতে রেকর্ড গড়ছে। সেখানে শনিবার (১ মে) একদিনে ৩ হাজার ৬৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
এর মধ্যেও সুখবর হল, সংক্রমণ আগেরদিনের চার লাখ থেকে কমে ৩ লাখ ৯২ হাজারে নেমে এসেছে। ভারতে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫৬ জন এবং মারা গেছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৫২৩ জন।
ভারতে শুক্রবারই প্রথম এক দিনে চার লাখের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়। তার আগে টানা নয় দিন ধরে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখের বেশি। তারও আগে ১৫ এপ্রিল থেকে দেশটিতে প্রতিদিন দুই লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছিল। আর টানা এক সপ্তাহ ধরে ভারতে দুই হাজারের বেশি মানুষ করোনায় মারা যাওয়ার পর গত ২৭ এপ্রিল থেকে দৈনিক মৃত্যু তিন হাজারের বেশি।
বিশ্বের কোনো দেশে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা রোগী শনাক্তের রেকর্ড এখন ভারতের দখলে। ২২ এপ্রিলের আগপর্যন্ত এই রেকর্ড যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে গত জানুয়ারিতে এক দিনে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। ভারতে শুক্রবার রেকর্ড চার লাখের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়।
ওয়ার্ল্ডোমিটারস শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ কোটি ২৮ লাখ ৮৩১। বিশ্বে করোনায় মোট মারা গেছেন ৩২ লাখ ৬ হাজার ৪৫১ জন।
ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৩১ লাখ ৪৬ হাজার ৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মোট মারা গেছেন ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭০৪ জন।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পরেই রয়েছে ভারত। ভারতের পর রয়েছে ব্রাজিল। সম্প্রতি সংক্রমণের দিক দিয়ে ব্রাজিলকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে ভারত। ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৪৭ লাখ ২৫ হাজার ৯৭৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬৫ জন।
ভারতে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্রে। তারপর রয়েছে কেরালা, কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, দিল্লি, অন্ধ্র প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ছত্তিশগড়, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানার পরিস্থিতিও অবনতিশীল।
গতকাল স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে ৬৩ হাজার ২৮২ জনের করোনা শনাক্ত হয়। কর্ণাটকে ৪০ হাজার ৯৯০ জন। কেরালায় ৩৫ হাজার ৬৩৬ জন।
করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির মুখে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
১ মে থেকে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে (১৮ বছরের ঊর্ধ্বে) টিকাদান কর্মসূচি শুরু করছে ভারত। তবে বিভিন্ন রাজ্যের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের টিকার সংকট রয়েছে।
ভারতে সংক্রমণের ‘বিস্ফোরণের’ জন্য করোনার ভারতীয় ধরনকে অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে। ভারতে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় দেশটি তার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অক্সিজেন, জরুরি ওষুধ, হাসপাতালে শয্যার সংকটসহ নানা সমস্যায় দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম।
দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকায় চাপ সামাল দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। শুধু অক্সিজেনের অভাবেই অনেক রোগী মারা গেছেন। বিদেশ ও দেশের অন্য এলাকা থেকে অক্সিজেন এনে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ভারতের করোনা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশ ও সংস্থা জরুরি চিকিৎসাসহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। বিদেশি সহায়তা ভারতে পৌঁছানো শুরুও হয়েছে।
ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে আরম্ভ হয়। দেশটির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনো পিক বা চূড়ায় উপনীত হয়নি। এ কারণে দেশটিতে করোনার সংক্রমণ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা কবে নাগাদ নিম্নমুখী হতে পারে, সে সম্পর্কে দেশটির বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
মহামারি করোনায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। শহরটিতে প্রতি চার মিনিটে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। এ অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে চলছে অক্সিজেনের তীব্র সংকট।