ঢাকাই সিনেমায় অ্যাকশন ছবির সোনালী সময় ছিল আশি-নব্বই দশক। সেই সময়ের পর্দা কাঁপানো নায়ক ছিলেন চিত্রনায়ক রুবেল। তার ছবি হলে এলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তো দর্শক। কারণ রুবেল ছিলেন সেই সময়েল কুংফু কিং। তাকে বলা হতো ঢাকাই ছবির ব্রুসলি।
তার ছবিতে ঢাকার দর্শক হলিউডের ব্রুসলির মারামারি উপভোগের বিনোদন পেতেন। সেই নায়কের আজ ৫৯তম জন্মদিন। জীবনের সুন্দর এই দিনে তিনি ভাসছেন প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায়।
তবে ছেলের পরামর্শ মেনে সবরকম আয়োজন থেকে বিরত আছেন৷ তার ভাষায়, ‘ছেলে বলছে এবার কিছু করার দরকার নেই। সমাজে আমার একটা ইমেজ আছে। করোনার মধ্যে লোক জড়ো করে আয়োজন না করাই উত্তম। তাই ঘরে আছি৷ অনেকে কল দিচ্ছেন৷ তাদের সঙ্গে কথা বলছি।’
‘জীবনের এই সময়ে এসে বলবো বেশ ভালো আছি। দোয়া চাই সবার কাছে। আমার খুব ভালো লাগছে অনেকেই এই দিনটি মনে রেখেছেন। প্রত্যেককে অন্তরের গভীর থেকে শুভেচ্ছা, ভালোবাসা’- রুবেল বলেন।
জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে বলেন, ‘ভালোবাসাই আমার কাছে সেরা উপহার। এর উপরে কোনো উপহার হতে পারে না। জীবনে তো অনেক টাকা আয় করেছি। অনেক কিছু পেয়েছি।
আমি আল্লাহ বিশ্বাসী। জীবনকে উপভোগ করতে চাই। সেটা সুন্দরভাবে। সৎভাবে। যত দিন বেঁচে থাকবো হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবো। আল্লাহকে ডাকতে চাই। এই বয়সে অন্য কিছু চিন্তা করতে চাই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার, রোজা রাখার, নিয়মিত কোরআন পড়ার।’
সর্বশেষ গত নভেম্বরে একটি সিনেমার শুটিং করেছেন রুবেল। তারপর ‘একাত্তরের গেরিলা কমান্ডার’ নামের আরেকটি সিনেমার শুটিং করার কথা ছিল তার। কিন্তু করোনার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
নায়ক রুবেলের পারিবারিক নাম মাসুম পারভেজ রুবেল। তিনি কিংবদন্তি অভিনেতা মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার ছোট ভাই। রুবেল ১৯৬০ সালের ৩ মে বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহন করেন।
২২ বছর বয়সে পরপর দুইবার যথাক্রমে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় ২৬ বছর বয়সে বড় ভাই সোহেল রানা প্রযোজিত ও শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘লড়াকু’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আগমন করেন।
রুবেলের দাম্পত্য সঙ্গী সুলতানা পারভেজ নীলা। সুখের সংসারে তাদের রয়েছে এক পুত্র সন্তান। নাম তার নিলয় পারভেজ।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ২০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন রুবেল। তার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। যেমন কোনো জুটি প্রথায় আবদ্ধ না হয়ে একাধিক নায়িকাকে নিয়ে তিনি সফল ছবি উপহার দিয়েছেন। কাঞ্চন-দিতি, কাঞ্চন-চম্পা, মান্না-চম্পা, নাঈম-শাবনাজ জুটি যখন তুমুল জনপ্রিয় তখনও রুবেল নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন নিজস্ব ধারায় তেমনি সানি-সালমানদের যুগেও তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় নায়ক।
দীর্ঘ দিনের ক্যারিয়ারে রুবেল অভিনয় করেছেন দুই বাংলার প্রায় ৫০ জন নায়িকার সঙ্গে। তারমধ্যে কবিতা ও পপি হচ্ছেন সর্বাধিক ছবির নায়িকা। রুবেলের অন্যান্য নায়িকারা হলেন রানী, জিনাত, শতাব্দী রায় (কলকাতা), সন্ধ্যা, চম্পা, সাথী, মিশেলা, সুচরিতা, পরী, দিতি, একা, মৌসুমি, অরুণা বিশ্বাস, লিমা, নন্দিনী, শিল্পী, তামান্না, সিমলা, কেয়া, সোনিয়া, শাহনাজ, সাহারা, শাহনূর প্রমুখ।
৯০ দশকের একেবারে শেষের দিকে রুবেল নিজে প্রযোজনা ও পরিচালনায় নামেন। তিনি এ পর্যন্ত ১৭টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন যার সবগুলোই ছিলো বাম্পার হিট। তার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিগুলো হচ্ছে বিচ্ছু বাহিনী, মায়ের জন্য যুদ্ধ, প্রবেশ নিষেধ, বাঘে বাঘে লড়াই, টর্নেডো কামাল, বিষাক্ত চোখ, রক্ত পিপাসা, সিটি রংবাজ, খুনের পরিণাম, অন্ধকারে চিতা, চারিদিকে অন্ধকার ইত্যাদি।
রুবেল শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না সেই শুরু থেকেই তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি ফাইট ডাইরেক্টর হিসেবেও সফল ছিলেন। তার সবগুলো ছবিতেই ‘দ্যা একশন ও্যারিয়রস’ নামে নিজস্ব ফাইটিং গ্রুপ ছিল। বলতে গেলে সেই সময়ে বাংলাদেশে মার্শাল আর্টকে জনপ্রিয় করে তুলেন রুবেল। যার ফলে তখন অনেক কিশোর তরুণ মার্শাল আর্ট শিখতে উৎসাহী হয়। রুবেল তার বিভিন্ন ছবিতে মার্শাল আর্ট এর ভিন্ন ভিন্ন নতুন কলাকৌশল উপস্থাপন করতেন। যার মধ্য ‘ড্রাংকিং কংফু’ (শত্রু সাবধান), উইপিং কংফু (বাঘের থাবা), ড্যান্সিং কংফু (ভণ্ড), ব্লাইনড কংফু (চারিদিকে শত্রু) সহ দুর্দান্ত সব কলাকৌশল উপস্থাপন করেন।
বাংলা সিনেমার সোনালী দিনের ইতিহাসে রুবেল চিরদিন থেকে যাবেন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে, অভিনয় আর নিজেকে উপস্থাপনের স্বকীয়তায়। রুবেল চিরদিন এদেশের সিনেমার দর্শকের কাছে চমৎকার এক ভালোবাসার নাম হয়ে রইবেন।