বাবা শাশ্বত, চির আপন। ভাষা ভেদে হয়তো শব্দ বদলায়, স্থান ভেদে বদলায় উচ্চারণও। কিন্তু বদলায় না রক্তের টান। আমেরিকায় যিনি বলেন ‘ড্যাড’বাংলায় তিনি ‘বাবা-আব্বা’বলে থাকেন। বাবার প্রতি সন্তানের চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। অবশ্য বাবার জন্য বিশেষ দিন হিসেবে প্রতি বছর ‘বিশ্ব বাবা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। আজ বিশ্ব বাবা দিবস।
‘বাবা দিবস’ আমাদের দেশে নতুন হলেও অপরিচিত নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই দিবসটি পালিত হচ্ছে এ দেশে। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দিবসটি পালন করা হয়। সে হিসেবে এ বছর বাবা দিবস ২০ জুন।
সনোরা স্মার্ট ডোড নামের এক তরুণীর মাথা থেকে প্রথম বাবা দিবসের ধারণাটা আসে। তিনি ছিলেন পরিবারের ছয় ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র মেয়ে। মার্কিন গৃহযুদ্ধে তার বাবা অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় তার মা সবাইকে নিয়ে ওয়াশিংটনের স্পোক্যানে চলে আসেন।
ডোডের যখন বয়স ষোলো তখন তার মা ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তাই বাবার সাথে তার সম্পর্কের স্রোত নানা বাঁকে মিশে এক মোহনায় মিলিত হয়।
‘বাবা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সনোরার মাথায় আসে ১৯১০ সালে। ‘মা দিবস’ নিয়ে সেই বছর গির্জায় ভালো ভালো কথা শুনেছিলেন তিনি। তখন মনে হয়েছিলো শুধু মা নয়, বাবা নিয়েও এরকম একটি দিন থাকলে ভালো হয়। এই চিন্তা থেকেই সনোরা গির্জার যাজককে ৬ জুন তার বাবার জন্মদিনটি ‘বাবা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের জন্য প্রস্তাব দেন। যদিও যাজক প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালনের ঘোষণা দেন।
প্রথম দিকে তেমন কোন সাড়া মেলেনি দিবসটি ঘিরে। ১৯২০ সালে বাবা দিবসের প্রচারণা বন্ধ করে সনোরা শিকাগোর আর্ট ইনিস্টিটিউটে পড়তে চলে যান। তখন বিষয়টি অনেক জায়গাতেই ফিকে হয়ে যেতে থাকে। ১৯৩০ সালে সনোরা স্পোক্যানে ফিরে এসে আবারও বাবা দিবস নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন।
এই সময় তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে কাজ করতে থাকেন। বিশেষ করে বাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে এরকম দ্রব্য- যেমন টাই, তামাক খাওয়ার পাইপ- যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তাদের সাথেই বাবা দিবস নিয়ে কাজ করতেন বেশি।
১৯৩৮ সালে নিউ ইয়র্ক অ্যাসোসিয়েটেড মেন’স ওয়্যার রিটেইলারস-এর তৈরি করা ফাদার’স ডে কাউন্সিলের সাহায্যে বাণিজ্যিকভাবে দিবসটি নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যান সনোরা। তখন মার্কিনিরা এর বিরোধিতা করেন। তারা বলতে থাকেন ‘মা দিবস’-এর বাণিজ্যিক সাফল্য দেখেই নতুন আর একটি ব্যবসা তৈরি করার জন্য ‘বাবা দিবস’ এর সুচনা করা হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় সমালোচনা করে খবর প্রকাশিত হয়। তবে ফাদার’স ডে কাউন্সিল এতে পিছপা হয়নি। সে কারণে তারা সাফল্যও পান। ১৯৮০ সালে এই কাউন্সিল একটি লেখায় জানান- ছেলেদের পণ্য যারা তৈরি করেন তাদের জন্য ‘বাবা দিবস’ এখন দ্বিতীয় ক্রিসমাস হিসেবে পরিচিত।
এভাবে দিন এগুতে থাকে। ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টায়। ১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবসটি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লেন্ডন বি. জনসন প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত দেন। ছয় বছর পর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সসনের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইন করে দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৭২ সালে।
মা দিবসের অনুকরণে হলেও এখন এদেশেও ‘বাবা দিবস’ বেশ ভালোভাবেই উদযাপন করা হয়। দেশের ফ্যাশন হাউজগুলো দিবসটিকে ঘিরে নতুন পোশাক বাজারে নিয়ে আসে। সন্তান বাবাকে নানা রকম উপহার দিয়ে দিনটি পালন করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইটের সুবাদে বাবা দিবস ঘটা করেই পালিত হচ্ছে। দিনটিতে বাবাদের নানাভাবে শুভেচ্ছা জানানো বা স্মরণ করা হয়। এখন সময় পাল্টেছে দিবসটিকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বাবাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। বাবার ছবি শেয়ার দেন অনেকে, মন্তব্য করেন, কবিতা লিখেন, বাবাকে নিয়ে লিখেন স্মৃতিকথা।
বাবা দিবসে আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হোক বাবা আমরা তোমাকে ভালোবাসি। যে দায়িত্ব নিয়ে তুমি আমাদের মানুষ করে তুলেছো, আমরা তা ভুলিনি, ভুলবো না কোনোদিন। যে সেনাপতি যুদ্ধ পরিচালনা করেন তার চাইতে কোন অংশে কম নন বাবা। আমাদের জীবন যুদ্ধের সেনাপতি তিনিই।
বাবার কাঁধে সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্বের কথা ভুলে যাই। কখনো কখনো উপার্জন ক্ষমতাহীন বৃদ্ধ বাবাকে বোঝা ভাবতে আমাদের হৃদয় এতটুকুও কাঁপে না। যে বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু সেই বাবাকে যেনো কোনো সন্তানের চোখে কখনো অবহেলা দেখতে না হয়। তাই সন্তানের কাছে প্রতিটা দিন হয়ে উঠুক বাবা দিবস। পৃথিবীর সকল বাবার মুখে থাকুক ভালোবাসা হাসি।