আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী, জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সরকারের নির্দেশে এবং কিছু অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে বলপ্রয়োগ, নির্বিচারে গুলি, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে জন-আন্দোলন দমন করা হয়েছে। এতে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন।
সাবেক পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
গত ২৪ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তিনি এই জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের রাতের ভোট, পুলিশের ভূমিকা, আয়নাঘর, ক্রসফায়ার ও জুলাই আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন সাবেক আইজিপি।
জবানবন্দি দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি সারা জীবন সততা, নিষ্ঠা ও আইন অনুসরণের মাধ্যমে আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করি। সরকারের পতন, জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ও বিবেকের তাড়নায় আমি স্বেচ্ছায় এই জবানবন্দি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে জুলাই আন্দোলনে সরকার ও বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাত ৮-৯টার দিকে কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান ও রেজা মোস্তফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিবির ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার জিডি মেজর জেনারেল এ.কে.এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন নির্দশনা ও পরামর্শ আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন।
কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিএফআই ও ডিবিপ্রধান হারুনকে আটক করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় এবং সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন ও চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, কোর কমিটির মিটিংয়ে তাদের আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে তাদের আটক করা হয়। ডিবিপ্রধানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিল। আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে জ্বিন নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।
আন্দোলন দমাতে এক পর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি, ডিজি র্যাবের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি ওই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।
সাবেক আইজিপি বলেন, আন্দোলন দমাতে পরবর্তীতে মারণাস্ত্র ব্যবহার ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে আমাকে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য মারণাস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আমার সামনে এডিশনাল ডিআইজি (সদর দপ্তর) প্রলয় জোয়ার্দ্দার উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা জানতে পারেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ডিএমপি কমিশনারের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ডিএমপিপ্রধান ও ডিবিপ্রধান মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন, যে কোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। গত বছরের ১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার প্রকাশ্যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম মেম্বার জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরফাত, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ এবং উসকানি দিতেন। দেশব্যাপী এত অধিক সংখ্যার মানুষ মারা যাওয়ার পরেও তারা তাদের উসকানি বন্ধ করেননি কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে থামতে বলেননি।
গত বছরের ১৭ জুলাই ছাত্রলীগ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা করে, সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। মূলত ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ছাত্রলীগকে ওবায়দুল কাদের, নানকসহ কিছু নেতা লেলিয়ে দেন। সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদের আগ্রাসী বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের ও নানক ছাত্রলীগ-যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন।
গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি, সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিং চলাকালে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে ও বিভিন্নস্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।
ওইদিন রাতে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী, তার বোন শেখ রেহানা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাব প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এসবি প্রধান মনিরুল বাইরে বসেছিলেন। জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই প্রধান বাইরে ছিলেন। খোলামেলা কথা হয়। কীভাবে ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায় তা নিয়ে কথা হয়। ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বৈঠক প্রায় ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, র্যাব প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার ও আমি ছিলাম।
সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশ মুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে সিদ্ধান্ত হয়।
সাবেক আইজিপি আরও বলেন, পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের (পুলিশ) শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশ মুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থান করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা দেন। সকাল ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে, সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকাতে। আমি দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে, সরকার পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সোনাবাহিনী তা জানায়নি।
বিকেলে জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে হেলিকপ্টার আসবে। আমি ওই হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি, বলেন সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন।