শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন

মাফিয়া আমলার সাতকাহন

সবুজবাংলা টিভি / ৮ পাঠক
প্রকাশ বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

ড. আহমদ কায়কাউস; আমলা হিসেবে যাঁর উত্থান রূপকথার গল্পের মতো। কিছুই ছিলেন না।

কিন্তু হঠাৎ করে তিনি আসেন পাদপ্রদীপে। সরকারি চাকরিকালীন শিক্ষা ছুটি নিয়ে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। সেখানে গিয়ে তিনি পিএইচডির পাশাপাশি গ্রহণ করেন মার্কিন নাগরিকত্ব। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি দেশে ফেরেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকার পরও তার সরকারি চাকরি বহাল থাকে। তরতর করে তিনি আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পদে চলে যান অলৌকিকভাবে। আমলাতন্ত্রকে করেছিলেন মাফিয়া রাজত্ব। আমলাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের এক দুষ্ট চক্র। সেই মাফিয়া চক্রে নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাবান থেকেছেন দিনের পর দিন। সুবিধাবাদী এ আমলা ২০২৪-এর নির্বাচনের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে দুর্নীতি, লুটপাট তিনি করেছেন, তাতে তার টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ সময় তিনি সরকারের টাকায় বিদেশে চাকরি নিয়ে যান। আবার আওয়ামী লীগের পতনের আগে আগে বিশ্বব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন একটি মার্কিন কোম্পানিতে। এখন বিপুল সম্পদ বিদেশে পাচার করে বিত্তবৈভবে দিন কাটাচ্ছেন। আহমদ কায়কাউস আমলা হিসেবে মধ্যমানের। ৮৪ ব্যাচের এ আমলার প্রশাসনিক জীবনের কাজের অভিজ্ঞতা খুবই কম ছিল। না ছিলেন তিনি জেলা প্রশাসক, না ছিলেন তিনি মাঠের কোনো শীর্ষ পদে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাতারাতি ক্ষমতাবান হয়ে যান। তার এই ক্ষমতাবান হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে ছিল এস আলম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে ড. আহমদ কায়কাউস এস আলমের ঘনিষ্ঠ হন। এস আলমের লুণ্ঠন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল একজন আমলা। বাংলাদেশের শীর্ষ এ অর্থ পাচারকারী তার এলাকার লোক হিসেবে আহমদ কায়কাউসকে বেছে নিয়েছিলেন তার লুটের সহায়তাকারী হিসেবে। আহমদ কায়কাউস তার অবৈধ অর্থের সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করেন। আর এ সহায়তা করতে গিয়ে আহমদ কায়কাউসও বানিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। যেখানে যাকে প্রয়োজন এস আলম তাকে পদায়ন করার জন্য নির্দেশনা দিতেন। আহমদ কায়কাউস সেই নির্দেশনা পালন করতেন। এস আলমের কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন হয়েছিলেন ড. আহমদ কায়কাউস। তবে তার উত্থান ঘটে যখন তিনি সচিব হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব পান। সচিব হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই তিনি শেখ হাসিনা পরিবারের বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠন এবং দুর্নীতি দেখভাল শুরু করেন। এ দেখভাল করতে গিয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হয়ে যান। তখন থেকেই তার উত্থানের সূচনা। বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি একের পর এক কুইক রেন্টাল অনুমোদন দিয়েছিলেন। এসব অনুমোদনের মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এ সময় তিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন আমলা হিসেবে পরিচিতি পান। এরপর তার পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেখা যায় ড. আহমদ কায়কাউস যখন বিদ্যুৎ সচিব ছিলেন, তখনই ৩১টি কুইক রেন্টাল অনুমোদন দেওয়া হয়। যার সবকটি থেকেই মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন।

 

২০১৮-এর রাতের ভোটের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তাকে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমদ কায়কাউস। এ সময় পুরো আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এ দুর্বৃত্ত মাফিয়া আমলা। তিনি একাধারে বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং সেক্টরসহ সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের ওপর কর্তৃত্ব করতে শুরু করেন। আমলাতন্ত্রে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাদেরই তিনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যারা তার বিশ্বস্ত এবং তার কথায় কাজ করবে। আর এখান থেকে শুরু হয় আমলাতন্ত্রের মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যেসব মন্ত্রণালয়ের বাজেট বেশি, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে তিনি দুর্নীতিবাজ আমলাদের বসান। তাদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি হয় কমিশন বাণিজ্যের। যেমন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ে বিপুল পরিমাণ বাজেট রাখা হয় থার্ড টার্মিনালের জন্য। তিন দফা বাড়িয়ে প্রাক্কলিত মূল্যের তিন গুণ করা হয় বাজেট। আর এ কারণেই তিনি তার ঘনিষ্ঠ আমলা হিসেবে পরিচিত একজন দুর্নীতিবাজ আমলাকে বেসরকারি বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে তার একান্ত অনুগত এবং বাধ্যগত ব্যক্তিকে সচিব করেন। যারা তার কথা শুনত, তাদের জন্য করেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা। ব্যাংকিং সেক্টরে লুণ্ঠনের মাস্টার মাইন্ড ছিলেন আহমদ কায়কাউস। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের চিরায়িত রীতি ছিল যে, একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদকে বা বিশেষজ্ঞকে এ দায়িত্ব দেওয়াা হয়, সেটি না করে তিনি সেখানে একজন আমলাকে বসান। এ আমলা আহমদ কায়কাউস এবং এস আলমের নির্দেশ ছাড়া অন্য কোনো কিছু করতেন না। আবদুর রউফ তালুকদার ছিলেন আহমদ কায়কাউসের কলের পুতুল। তার মাধ্যমেই ব্যাংকিং সেক্টরে লুণ্ঠন শুরু হয় এবং অর্থ পাচারের একটা স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। এভাবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে বেছে বেছে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বসিয়ে সীমাহীন লুণ্ঠন করেছেন আহমদ কায়কাউস। আমলাতন্ত্রকে তিনি ক্ষমতাবান বানিয়েছেন। মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদদের ওপর ছড়ি ঘোরানো, রাজনীতিবিদদের কম ক্ষমতাবান করে আমলাদের ক্ষমতাবান করার মূল কারিগর ছিলেন আহমদ কায়কাউস। তার নেতৃত্বেই আমলাতন্ত্র দুর্নীতির দানবে পরিণত হয়েছিল।

২০১৮ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার আস্তে আস্তে আমলানির্ভর একটি সরকারে পরিণত হয়। আমলারাই হয়ে ওঠেন সর্বময় কর্তা। এখান থেকে শুরু হয় ‘আওয়ামী আমলা মাফিয়া তন্ত্র’। ২০২০ সালে যখন বাংলাদেশ করোনায় আক্রান্ত হয়, তখন আহমদ কায়কাউস হয়ে ওঠেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত হন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনুদানের টাকা নেওয়া, বিভিন্ন ব্যাংকে চাপ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা নেওয়াসহ নানা অপকর্মের মূল হোতা হলেন এই আহমদ কায়কাউস। যিনি প্রশাসনের সব নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করেছিলেন। আর এখানেই আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনটির মৃত্যু হয়।

আহমদ কায়কাউস কোনো মন্ত্রীর কথা শুনতেন না। কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথাও শুনতেন না। শেখ হাসিনা ছাড়া তিনি কাউকে পাত্তা দেন না- এই কথা তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন। এ আমলাতন্ত্রের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি আমলাদের অবাধ লুণ্ঠনের যেমন সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তেমনি তিনিও বানিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমলাদের যে উত্থান এবং অপকর্ম হয়েছে, সেই উত্থান এবং অপকর্মের মূল হোতা হলেন আহমদ কায়কাউস।

আহমদ কায়কাউসের দুর্নীতি এবং অপকর্মকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, তিনি আমলাতন্ত্রের ভেতর দুর্নীতি ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এসব সচিব প্রত্যেকটা উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিভিন্ন বরাদ্দের অর্থ নির্দিষ্ট হারে লুণ্ঠন করতেন এবং একটি অংশ আহমদ কায়কাউসকে দিতে হতো। যেমন- ধরা যাক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশে যে ছোট ছোট ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণের জন্য ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিল। বাস্তবে এটির কাজ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। আমলারা এ টাকা লুণ্ঠন করেছেন এবং লুণ্ঠনের টাকার একটি অংশ আহমদ কায়কাউসের পকেটে গেছে। সেই টাকা অবশ্য দেশে থাকেনি, বিদেশে গেছে।

দ্বিতীয়ত, করোনার সময় টিকা আমদানিসহ করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার্য সামগ্রী ক্রয় করার জন্য সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা খরচ করেছে। এর মধ্যে খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ২০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৮০ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন হয়েছে। যে লুণ্ঠনের একটি বড় অংশ পেয়েছেন আহমদ কায়কাউস। তৃতীয়ত, এস আলমের নির্দেশে আহমদ কায়কাউস ব্যাংকিং সেক্টরে এক অরাজকতা সৃষ্টি করেন, লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন ব্যাংকিং সেক্টর। আর এটি করার জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক তছনছ করেছিলেন।

চতুর্থত, বিদ্যুৎ খাতকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক লুণ্ঠনের জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি যখন বিদ্যুৎ সচিব ছিলেন, তখনই বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুতের তথাকথিত চুক্তির মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্যের সূচনা করেছিলেন।

পঞ্চমত, তার যে অপকর্ম সেটি হলো বিভিন্ন সামাজিক বেষ্টনী প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করা।

এ প্রসঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কথা বলা যায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে সারা দেশে গৃহহীনদের জন্য বাড়ি করে দেওয়ার এ পরিকল্পনা ড. আহমদ কায়কাউসের। তিনি এ নিয়ে আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং প্রত্যেক সচিবকে নির্দেশ দেন যে, তাদের কিছু বাড়ি করে দিতে হবে। একজন আমলা নির্দিষ্ট আয়ের বেতন পান। নির্দিষ্ট বেতনে তাকে চলতে হয়। তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি নিজের টাকা করবেন কীভাবে? কিন্তু দেখা গেছে যে, আহমদ কায়কাউসকে খুশি করার জন্য এবং অবাধে দুর্নীতি লুটপাট করার জন্য কেউ ১০টি, কেউ ২০টি, কেউ ৫০টি পর্যন্ত নির্মাণ করে দেন। এর বিনিময়ে তারা পদোন্নতি পেয়েছেন, পেয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। অবাধ দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন। আর আহমদ কায়কাউস পেয়েছেন কমিশন। দেশে কোনো টাকা নিতেন না। বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন আমলাতন্ত্রের এ মাফিয়া দুর্নীতিবাজ। ড. আহমদ কায়কাউস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিকে যোগদান করেছেন। মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক এমজিএস সাবেক কংগ্রেসম্যান জেমস জি মরানের প্রতিষ্ঠিত একটি লবিস্ট ফার্ম। এই ফার্মে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। আহমদ কায়কাউসের বিরুদ্ধে দু-একটি দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ দেশের আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করার এই মূল কারিগর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন, সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।

সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন


এই পাতার আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর