‘সন্তান নেই, কান্না আছে—তবুও পাশে কেউ নেই’

একটি বছর কেটে গেছে। বাড়ির উঠোনে আর শোনা যায় না ইজিবাইকের শব্দ।
মায়ের চোখে শুধুই অপেক্ষার ক্লান্তি, বাবার কণ্ঠে কেবল শোক।
পঞ্চগড় পৌরসভার দর্জিপাড়া এলাকার সেই যুবক আল আমিন। যিনি এক সময় ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাতেন, এক বছর আগে ‘কাজ আছে’ বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর যোগ দেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’। তারপর থেকেই নিখোঁজ।
নিখোঁজ হওয়ার পর কেটে গেছে বারোটি মাস। অথচ এখনো মেলেনি তার কোনো সন্ধান। চোখে শুকনো কান্না আর মনে হাহাকার নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তার বাবা মনু মিয়া ও মা রুনা বেগম।
একমাত্র ভরসা হারিয়ে দিশেহারা পরিবার:
আল আমিন ছিলেন পরিবার ও অসুস্থ বাবা মায়ের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। তার অনুপস্থিতিতে ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবার। খাবার জোটে না নিয়মিত, চুলা জ্বলে না প্রতিদিন। একদিকে আল আমিনের নিখোঁজের পর ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে নিজ বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন আল আমিনের স্ত্রী সুমি আক্তার।
সরেজমিনে আল আমিনের বাড়ি গেলে প্রতিবেশীরাও বলছেন, এ পরিবারটি এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে।
প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, অসুস্থ বাবা মনু মিয়া। এক দিন কাজ করলে দুদিন কাজ করতে পারেন না। এ নিয়ে খুব কষ্টে আছে পরিবারটি। আল আমিনের কোনো খোঁজও নেই, সহায়তাও পাচ্ছে না কোথাও থেকে।
এদিকে পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি লিস্টে নাম না থাকায় এ পরিবারটি কোনো প্রকার সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে না। তাই পরিবারটির প্রতি সহানুভূতি দেখানোর দাবি জানাচ্ছেন এলাকাবাসী।
বাবা মনু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আন্দোলনে গিয়ে গত এক বছর ধরে আর বাড়িতে ফিরেনি আল আমিন। জানি না কি অবস্থায় আছে। অনেক খুঁজেছি, থানায় অভিযোগ ও মামলা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছেলেকে পাওয়া যায়নি। সে আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। আমরা খুব কষ্টে দিন পার করছি। আমার ছেলে যদি মারা যায় থাকে তবে তার লাশটি হলেও একবার দেখতে চাই।
এদিকে একই সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন আল আমিনের কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মা রুনা বেগম। সন্তানকে ফিরে পেতে অনুরোধ করছিলেন বারবার।
মামলা, তদন্ত আর অপেক্ষা:
নিখোঁজের তিন মাস পর মামলা হলেও, আজও নেই কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি বলে অভিযোগ করছে আন্দোলনের সমন্বয়করা। আর প্রশাসন বলছে, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন।
কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পঞ্চগড়ের সাবেক সমন্বয়ক ফজলে রাব্বির সাথে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আল আমিন ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকেই নিখোঁজ। যতটুকু তথ্য প্রয়োজন আমরা পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো অগ্রগতি তেমন নেই। পরিবারটিকে সে ভাবে সহায়তা করতে না পেরে আমরা তার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারছি না। এ ঘটনা খুবই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। আমরা চেষ্টা করছি পরিবারটিকে সহায়তা করার। এদিকে আল আমিনের স্ত্রীকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে সেলায় প্রশিক্ষণ ও অর্থিকভাবে কিছুটা সহায়তা করা হয়েছে।
আল আমিনের নিখোঁজ হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলেও, পরিবারটি এখনও অপেক্ষায়। শুধু একটি চাওয়া- তাদের সন্তানকে একটিবার দেখা, জানার সুযোগ সে কোথায়, কেমন আছে কিংবা আদৌ আছে কি না। স্থানীয়দের একটাই আবেদন- নিখোঁজ আল আমিনের খোঁজ পাওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনি তার অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো এখন মানবিক দায়িত্ব।