এর মধ্যে ইউটিউব, টিকটক আর ফ্রি ফায়ার গেম তো আছেই। স্কুল থেকে ফেরার পরও চলতে থাকে এসব। বলতে গেলে এটা তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এটা তার ছোট্ট ভুবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে
শিশুর সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিতে যেসব ক্ষতি
- প্রকাশকাল ০২:৫২:৪০ এএম, বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৭ পাঠক
মাহির মা নাদিয়া খানের (ছদ্মনাম) ভাষ্য, ‘ফোন না দিলে নানা রকম ঝামেলা করে ও। বিরক্ত করে। খেতে চায় না, পড়তে বসে না। যেন নেশা ধরে গেছে!’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু–কিশোর।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত ঢাকায় স্কুলপড়ুয়া কিশোর–কিশোরীদের ওপর চালানো একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২৪.৪৮ শতাংশের মধ্যে মাইল্ড (মৃদু) ইন্টারনেট আসক্তি, ১৩.৮ শতাংশের মডারেট (মাঝারি) এবং ১.০৪ শতাংশের সিভিয়ার (তীব্র) আসক্তি রয়েছে।
কভিড–১৯ মহামারির পর থেকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৩ শতাংশ শিশু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন, যার মধ্যে ফেসবুক সবচেয়ে অসুরক্ষিত এবং এরপর ইনস্টাগ্রাম। এই ঝুঁকির বড় একটি অংশে রয়েছে আসক্ত শিশুরা। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হলো টিকটক এবং শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলো। এগুলোর অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি যে শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করতে থাকে। শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শর্ট ভিডিও কনটেন্ট শিশুদের মস্তিষ্কে দ্রুত ডোপামিন (মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ দ্বারা তৈরি একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক বার্তাবাহক) নিঃসরণ করে, যা আসক্তি তৈরির প্রধান কারণ।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সহজলভ্য ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের ব্যাপকতা এবং মা–বাবার তত্ত্বাবধানের অভাব। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পরিবার এখন একক। যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার প্রভাব শিশুদের ওপরও পড়েছে। একক পরিবারের অভিভাবকরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই শিশুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে নিজেরা অনেক সময় ঝামেলামুক্ত হতে চান। এভাবে হয়তো সেই পরিবারের সাময়িক সুবিধা হয়, কিন্তু শিশুর মস্তিষ্কের বেশ ক্ষতি হয়ে যায়।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, ব্র্যাক ও ইউনিসেফের বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে। অনেকেই চার থেকে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনে থাকে। বাড়তি সমস্যা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা এই ব্যবহারের ধরন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না।
বাংলাদেশে ডিজিটাল সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা তুলনামূলকভাবে কম। অনেক পরিবার মনে করে, ফোনে শিশুর ভিডিও দেখাই হচ্ছে মূল সমস্যা। অথচ এর পেছনে থাকা গোপন ঝুঁকিগুলো কেউ গভীরভাবে ভাবেও দেখে না। এসবের মধ্যে আছে সাইবার বুলিং, ক্ষতিকর কনটেন্ট, অনলাইন গেমের আর্থিক ফাঁদ এবং অজানা লোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ঝুঁকি। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা নিরাপদ ইন্টারনেট নীতি নিয়ে কাজ করলেও পরিবারের ভেতরের সমস্যা এখনো সবচেয়ে বড় ফাঁক। এ জন্য অভিভাবকদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অভিভাবকের কয়েকটি পদক্ষেপ শিশুদের আসক্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে। যেমন—স্ক্রিন টাইম নির্দিষ্ট করা, শিশু কী দেখে তা জানার চেষ্টা করা, একসঙ্গে অফলাইনে সময় কাটানো, ফোন বা ট্যাবকে পুরস্কার বা শাস্তির হাতিয়ার না বানানো, শিশুদের ডিজিটাল সাক্ষরতা শেখানোর পাশাপাশি এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিপদগুলোর বিষয়ে তাদের সাবধান করা।
শিশুদের মানসিক সমস্যা নিয়ে শত শত অভিযোগ : সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। তারা জড়িয়ে যাচ্ছে অনলাইন জুয়া থেকে শুরু করে পর্নোগ্রাফিতেও। অনেকে ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান–হয়রানির শিকার হয়ে ট্রমাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব অভিযোগ জমা পড়ছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার ইউনিটে।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) ইন্টারনেটকেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ে কাজ করছে। ইউনিটটির প্রধান ডিআইজি মো. বাশার তালুকদার বলেন, ‘শিশু–কিশোরদের ক্ষেত্রে ফেসবুক হ্যাক করে কুৎসা রটনা, বিভিন্ন ধরনের ছবি পোস্ট করার অভিযোগ আসে। ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান–হয়রানির প্রবণতা লক্ষ করা যায়।’
ডিবির সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা অভিযোগে ২০ থেকে ৩০টি মামলা ও পাঁচ শতাধিক জিডি আসে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক অভিযোগ আসে স্কুল–কলেজ পড়ুয়া শিশুদের কাছ থেকে। শিশু–কিশোরদের অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে গিয়ে অনলাইন জুয়া, পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে যাওয়ার তথ্যও পাচ্ছে ডিবির সাইবার ইউনিট। ফলে অভিভাবকদের তরফ থেকে বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার) সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আসে। একজনকে ঘায়েল করতে আরেকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আসে। এতে অনেকে ট্রমাটাইজড হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ইন্টারমিডিয়েট পড়া পর্যন্ত অভিভাবকদের সন্তানদের খোঁজ রাখা দরকার। তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিরুৎসাহ করা দরকার।’

























